ছবি : সংগৃহীত

যেকোনো বড় মানুষকে ছোট করার অদ্ভুত প্রবণতা আছে বাঙালির। এই কাজটি বড় মানুষেরা কখনো করে না, করে যারা ছোট তারা।

যারা সব অর্থেই ছোট তারাই যেকোনো বড় মানুষকে ছোট করতে চায়, চায় চরিত্র হনন করতে, কুৎসা রটাতে উদ্ধত হয়-বিশেষ করে তার মৃত্যুর পর।

বানরের হাতে লাঠি আর বাঙালির হাতে প্রযুক্তি অনেকটা একই। ভালো কাজের চেয়ে মন্দে আগ্রহ বেশি আমাদের। প্রযুক্তির সুবিধাকেও তাই মন্দে ব্যবহার করছি বেশি, ভালোর চেয়ে।

সোশ্যাল মিডিয়াকে এখন রীতিমতো ভাগাড়ে পরিণত করেছি আমরা। বিশেষ করে ফেসবুক এখন অন্যের চরিত্র হননের নিকৃষ্ট জায়গা। হোক রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক-কোনো বড় মানুষকে ছাড়ছি না কুৎসা করতে। কী জঘন্য মানসিকতা!

আরও পড়ুন >>> পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন

নাম, যশ, খ্যাতি মানুষ কাজের মধ্য দিয়ে অর্জন করে। কত অজপাড়া গাঁ, গহীন গ্রাম থেকে মানুষ উঠে এসে জগৎ বিখ্যাত হয়ে যায়-নেহাত কর্মের দ্বারা। মনে রাখতে হবে কাজই মানুষকে পরিচিত করে, পরিচিতি দেয়।

অকাজের কোনো স্থান নেই সমাজ-সংসারে। ফলে বিকৃত মানসিকতার ‘ফেইম সিকার’, ‘অ্যাটেনশন সিকার’ হয়ে খুব বেশি লাভ নেই, যদি না দৃশ্যমান কাজ থাকে। হয়তো লোকে ক্লিক করবে, ভিউ বাড়বে আবার তা তৎক্ষণাৎ ভুলেও যাবে, তা এক অসহ্য বাস্তবতা।

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম লেখক সমরেশ মজুমদার। দুই বাংলাতেই তার গুণমুগ্ধ পাঠক অগণিত। সমরেশ মজুমদার যে কত বড় মানের, বড় মাপের লেখক তা তার পাঠক মাত্রই জানেন।

সমরেশ মজুমদারের লেখক হিসেবে বিশাল, তার গুণবিচারের কোনো যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের জন্য খুব লজ্জার ও অসম্মানের তা হলো, তার মৃত্যুর পর কিছু তথাকথিত লেখক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে কুৎসা রটাতে তৎপর।

তিনি কোনো বড় লেখক নন, তার গর্ভধারিণী উপন্যাসটি নকল, পাঠক তাকে ভুলে যাবে—এসব যারা বলে বেড়াচ্ছেন তাদের শুধু একটাই কথা বলার আছে আমার—তারা এতদিন কোথায় ছিলেন?

আরও পড়ুন >>> শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অপরাজেয় কথাশিল্পী

তার জীবদ্দশায় তারা কোনো মন্তব্য করেননি কেন? যে কথিত লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে এসব মন্তব্য করছেন ভাইরাল হওয়ার প্রয়াসে তারা নিজেরাই তো পাঠকশূন্য। তাদের না আছে পাঠক, না আছে প্রকাশক। আত্মরতিতে ভোগা বিকৃত মানসিকতার একেকজন!

সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি পারিবারিক। সবসময় মনে করতাম তিনি আমাদের পরিবারের একজন। প্রকাশনা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আমার চাচা শামসুর রহমান এবং আলতাফ হোসেন ছিলেন এক সময়ে ঢাকার বড় বই আমদানিকারক। বিদেশি বই নিয়ে আসতেন তারা। সেই সূত্রেই পার্ল পাবলিকেশন্স, শামস পাবলিকেশন্স-এর প্রকাশনা যাত্রা।

সমরেশ মজুমদার ছিলেন মামা আলতাফ হোসেনের বন্ধু। ভীষণ অন্তরঙ্গতা ছিল তাদের। আমার দুই ভাই হাসান জায়েদী তুহিন এবং হাসান তারিক তুষারকে যারপরনাই ভালবাসতেন তিনি। মূলত বড় ভাই পার্ল পাবলিকেশন্স এর সত্ত্বাধিকারী তুহিনের মাধ্যমেই আমার সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয়।

ঢাকায় তিনি প্রতিবছর আসতেন। আসলেই ডাকতেন আমাদের। আমরা তার কথা শুনতে যেতাম, শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। যেমন রাজনীতি সচেতন তেমনি মানবিক বোধে উৎসারিত এক মানুষ।

ইতিহাস বলতেন, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস। বাংলাদেশ নিয়ে দারুণ উৎসাহ ছিল তার। বলতেন বাংলা পুরোটাই তার দেশ। দেখতে যেমন সুদর্শন ছিলেন, তেমন ভরাট কণ্ঠ, বাচনভঙ্গি আর যেকোনো বিষয়ে মানবিক বিশ্লেষণ দেওয়ার দারুণ ক্ষমতা।

আমরা তাকে মামা ডাকতাম এবং প্রতিবারই তিনি কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। একবার আবদার করে তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যদিও আমি তখন ছাত্র মাত্র।

আরও পড়ুন >>> মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত 

তার সঙ্গে অনেক সময়, অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। তবে তার একটি উপদেশ খুব মনে পড়ে। তিনি বলতেন পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। দাদুকে চেনে না, নানিকে চেনে না।

কিছুদিন দেশে লেখাপড়া করার পরই বাইরে চলে যাচ্ছে। ভালো, যাও। কিন্তু আর ফিরছে না। একদিন তারা বাবা-মাকেও আর চিনবে না। স্বার্থপর হয়ে উঠছে মানুষ। কেবল টাকার পেছনে ছুটছে। ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটছে। এই লাগামহীন ছোটা শেষ অবধি অর্থহীন।

সত্যিই তো তাই। দুই বাংলাতেই এই বাস্তবতা একই। মানুষ কেবল ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতো। কিন্তু কোথায় তার যাত্রা? কোথায় তার শেষ তা নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়?

সমরেশের মতো মানুষেরা এই যাত্রা নিয়ে ভেবেছেন। মানবিক চিন্তা করেছেন। মানুষের কথা ভেবেছেন। ভেবেছেন জীবনের গভীরতার কথা, বোধের কথা।

অথচ আমরা কী নির্মম, নৃশংস—একজন মানবিক মানুষের অনন্তযাত্রার পরও তার কুৎসা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারছি না!

জব্বার হোসেন ।। সম্পাদক, আজ সারাবেলা; সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র