মরণাপন্ন রোগীকে নিবিড় সেবা দিতে দেশে আইসিইউ শয্যা আছে দুই হাজারের মতো; সরকারি হাসপাতালে এক হাজারের কিছু বেশি এবং বেসরকারি হাসপাতালে এক হাজারের কিছু কম।

প্রায় সতের কোটি মানুষের দেশে নেহায়েত যে কম, তা বেশি করে অনুভূত হয়েছে করোনাকালে আইসিইউ-এর হাহাকার থেকে এবং সম্প্রতি ব্যাপক প্রচার পাওয়া নোয়াখালীর শাহিনের আইসিইউ না পেয়ে অকাল মৃত্যু থেকে। এর বাইরে আরও অসংখ্য ভুক্তভোগী জানেন তাদের স্বজনদের মরণাপন্ন অবস্থায় আইসিইউ না পাওয়ার যন্ত্রণা।

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে কমপক্ষে ২২ জেলায় কোনো আইসিইউ সেবা নেই। বেশিরভাগ আইসিইউ রাজধানী ঢাকা এবং বড় বিভাগীয় শহরে। ফলে এখনো আইসিইউ চাহিদা ও ভোক্তা মূলত শহরকেন্দ্রিক; অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই তা ব্যবহার করতে পারেন। শহরের নিম্নবিত্ত ও গ্রামের মানুষের কাছে তা সহজলভ্য নয়।

আরও পড়ুন >>> জীবন নিয়ে খেলা! 

প্রাইভেট হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি রোগীর দৈনিক মোট খরচ প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই। বাংলাদেশের ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ যেহেতু গ্রামে বাস করে, সুতরাং তারা গুরুতর অসুস্থ হলে, তাদের প্রায় শতভাগ ঢাকা বা বড় শহরের আইসিইউতে যেতে সমর্থ হয় না। অথচ আইসিইউ সেবা পেলে তাদের কেউ কেউ বেঁচে যেতেন।

আইসিইউ চাহিদা দুইভাবে হয়ে থাকে; কোনো রোগে ভর্তি হয়ে মরণাপন্ন হলে এবং ঘরেই গুরুতর অসুস্থ হলে। ভর্তি রোগী যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেখানে আইসিইউ থাকলে, তা খালি থাকলে এবং রোগীর আইসিইউ খরচ মেটানোর সামর্থ্য থাকলে ভাগ্যবান রোগী চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। 

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে কমপক্ষে ২২ জেলায় কোনো আইসিইউ সেবা নেই। বেশিরভাগ আইসিইউ রাজধানী ঢাকা এবং বড় বিভাগীয় শহরে। ফলে এখনো আইসিইউ চাহিদা ও ভোক্তা মূলত শহরকেন্দ্রিক...

আমাদের অনেক বড় সরকারি হাসপাতাল যেমন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র-নিটোরেও আইসিইউ নেই। অথচ এখানে শয্যা সংখ্যা এক হাজার এবং এই হাসপাতালের অনেক রোগীর নিবিড় চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

আইসিইউ সেবা অত্যন্ত উঁচুমানের বিশেষায়িত সেবা। এতে সার্বক্ষণিক সেবা প্রয়োজন হয়। একটি ১০ শয্যার আইসিইউতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকবেন ১৩ জন, অন্যান্য চিকিৎসক ৭ জন, অসুস্থতা নিরিখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স ১৬ জন, অন্যান্য সেবাদান কারী থাকবেন ১৬ জন।

আরও পড়ুন >>> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখানে মোট ৫০-৬০ জন স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রয়োজন। এত সংখ্যক জনবল বিশেষত ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ও নার্সের বড়ই অভাব এবং তাদের ডিগ্রি অর্জন ও প্রশিক্ষণে ৮-১০ বছর সময় লাগে। সুতরাং আইসিইউ সব জেলায় চালু করতে সিদ্ধান্ত নিলেই রাতারাতি চালু করা সম্ভব হবে না।

একই কারণে করোনাকালে সব জেলায় আইসিইউ চালু করার নির্দেশনা থাকলেও তা সব জেলায় চালু করা সম্ভব হয়নি এবং মেডিকেল কলেজ ব্যতিরেকে সদর হাসপাতালগুলোয় যে আইসিইউ চালু করা হয়েছে সেগুলো আইসিইউ স্থাপন ও পরিচালনের মূল শর্তগুলো কতটা পরিপূরণ করতে পারছে সেই বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আইসিইউ যদি শতভাগ চাহিদা পূরণ না করে পরিচালনা করা হয়, তবে সুতার উপর ঝুলতে থাকা জীবন রক্ষার চেয়ে জীবনহানি বেশি হবে। আমাদের দেশের আইসিইউ আউটকাম খুব ভালো নয়; সাধারণ আইসিইউতে মৃত্যুর হার মানসম্পন্ন আইসিইউ এর চেয়ে অনেক বেশি। 

সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসার মান কিছুটা স্বস্তির হলেও ছোট হাসপাতালগুলোর মান আদৌ আশাব্যঞ্জক তো নয়ই, বরং এগুলোর বিরুদ্ধে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ের অনেক উদাহরণ আছে।

বড় বড় সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসার মান কিছুটা স্বস্তির হলেও ছোট হাসপাতালগুলোর মান আদৌ আশাব্যঞ্জক তো নয়ই, বরং এগুলোর বিরুদ্ধে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ের অনেক উদাহরণ আছে।

দেশের আইসিইউ চিকিৎসা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এলাকাভিত্তিক আইসিইউ চাহিদা নিরূপণ করে বর্তমানে বিরাজিত আইসিইউগুলোয় সমন্বিত মানসম্পন্ন সেবা দানের লক্ষ্যে বিভাগ ধরে বণ্টন করতে হবে।

আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

প্রতিটি বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলোর নিবিড় সেবাদান চাহিদা অনুযায়ী ঐ বিভাগ থেকে পূরণ করতে হবে। আমাদের প্রত্যেক বিভাগে বড় বড় যে মেডিকেল কলেজ আছে, সেগুলোয় প্রয়োজনীয় লোকবল, যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি আছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তুলনামূলকভাবে সহজে আইসিইউ সুবিধা দেওয়া সম্ভব।

সব জেলা সদর হাসপাতালে ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) সুবিধা চালু করা তুলনামূলকভাবে সহজে করা সম্ভব। সুতরাং কম গুরুতর রোগীদের সব জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা গেলে আইসিইউর আশু সংকট স্বল্পমেয়াদে সমাধান সম্ভব।

মধ্যমেয়াদে ১০-১৫ বছরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক নার্স তৈরি করা গেলে ক্রমান্বয়ে সব জেলা হাসপাতালে এই সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে। দীর্ঘ মেয়াদে ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী আইসিইউ চলমান রাখা এবং মান সম্পন্ন টেকসই আইসিইউ ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক