ছবি : সংগৃহীত

সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আমিই বোধহয় ঠিক নেই। সব মানুষই ভালো আছে। একা আমার মাথাতেই মনে হয় গণ্ডগোল। শুধু আমার মাথাটাই ঘুরছে।

এলাম, ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি লেক পাড়ে। ভাবলাম শুধু প্রকৃতি দেখব। এখানে কেন ময়লা দেখবো না? কেন লেকের পানিতে প্লাস্টিক বোতল দেখবো না? কেন স্কুল শিক্ষার্থীয়া অসময়ে পার্কে মোবাইলে ব্যস্ত! না না না। সত্যি আজ এসব দেখে আমার শান্তি বিঘ্নিত করতে চাই না।

সাধারণ মানুষ, সাধারণ থাকায় ভালো। সবাই চোখ উল্টে বসে আছে। আমার একার দায় কী! প্রশাসন যন্ত্র—ও বাবা ওদিকে তাকানোই যাবে না। সাধারণের কণ্ঠস্বর—লাভ নেই কোনো লাভ নেই।

আরও পড়ুন >>> কত শিক্ষক অপমানিত হলে আমাদের ঘুম ভাঙবে? 

আজকাল আমাদের সমাজপাঠ সিলেবাসে একটা নতুন শব্দ যোগ হয়েছে—কিশোর গ্যাং। শব্দটার মধ্যে একটা সিনেমাটিক গন্ধ আছে। ছুরি হাতে আমার কিশোর ছেলে আরেক কিশোরের পেছনে দৌড়াচ্ছে। রক্তের নেশা তার চোখে মুখে। এই দৃশ্য খুব নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি আমার মস্তিষ্ককে বলছি, শান্ত হও, শান্ত হও হে উত্তপ্ত মস্তিষ্ক। আশপাশে চোখ পড়ছিল, কিন্তু জোর করে চোখ বন্ধই রাখতে চাইছিলাম। চোখ বন্ধ করেই বুক ভরে সতেজ বাতাস নিচ্ছিলাম। হঠাৎ বোটকা গন্ধ বাতাসে উড়ে এসে নাকে আটকে গেল। এদিক ওদিক তাকাতেই চোখ পড়ে গেল ছেলেটার দিকে। বুঝতে পারলাম সে মাদক সেবনে ব্যস্ত।

জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কোন স্কুলে পড়ো? কিশোরের উত্তর—নাম কমু, কিছু করতে পারবেন? পুরো জাতির গালে চড় কষিয়ে দিল যেন।

চোখ সরিয়ে নির্বিকার হতে চাইছিলাম। একটু পর প্লাস্টিকের ঠোঙা হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো আরেক কিশোর। চোখ লাল টকটকে। মাথার চুল ধুলোবালি মাখা উসকোখুসকো। উদ্ধতভাবে জিজ্ঞেস করল এই যে ম্যাডাম কেমুন আছেন?

আমি বোঝার চেষ্টা করছি। একে কি আমি চিনি? সে বলল, চিনবার পারেন নাই! আপনার ক্যামেরাডা কই? বুঝলাম আমাকে ও ক্যামেরা হাতে দেখেছে। কয়েকদিন আগে মহাখালীর ফ্লাইওভারের নিচে ওদের কয়েকজনের ছবি তুলেছিলাম।

কিশোর হাসতে হাসতে উদ্ধত ভঙ্গিতেই বলল ওই যে হেইদিন আমাগো ছবি তুইলা আইল্যান্ডে উডোনের সময় হুড়মুড় কইরা পইড়া গেলেন। ক্যামেরাডা বাঙলে খুশি হইতাম। আচ্ছা ম্যাডাম আপনি হিন্দু না মুসলমান?

আরও পড়ুন >>> শিক্ষক লাঞ্ছনায় সবাই নিশ্চুপ কেন? 

আর যাই হোক এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কেন হিন্দু হলে কী সুবিধা আর মুসলিম হলে কী সুবিধা! ছেলেটি আমার সরল চিন্তাকে ভোঁতা করে দিয়ে উত্তর দিল নিশ্চয়ই আপনি হিন্দু হেইজন্যই তো পইড়া গেলেন। হাসবো না কাঁদবো!

হতবিহ্বল হয়ে শুধু ভাবলাম, আমরা কি সত্যিই জানি না ভয়ংকর বিষবাষ্প কীভাবে এই কিশোরদের বুকে ঠাঁই করে নিয়েছে?

কিশোর চলে যাওয়ার সময় স্পষ্ট করে বলে গেল—আরেকদিন ছবি তুইলা দেইহেন। ভয়ংকর হয়ে উঠলো ওর চোখ। সঙ্গে সঙ্গে আরও ৫-৬ জন কিশোর ঘিরে ধরল।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কেন খাও ওসব? জিজ্ঞাসা করতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল সবাই। বলল, হেইডাও কি আপনারে জবাব দিতে হইবো। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছিলাম ওদের কথা শোনার জন্য। আবার বললাম কী নাম তোমার বাবা?

কী যে এক বিষদৃষ্টি দিয়ে চলে গেল ওরা। বলে গেল, ভাইয়ের সাথে কথা কইয়া নিয়েন‌। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। কারা এদের বড় ভাই? তার মানে এদেরও গডফাদার আছে। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গান্ধারীর ভূমিকায় প্রশাসন যন্ত্র, রাজনীতি, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক আমরা সবাই।

সেদিন হলো আরেক ঘটনা। হাতিরঝিলে স্কুল ফেরত অথবা আদৌ স্কুলে যায়নি এমন জনাপঞ্চাশেক ছাত্র-কিশোর জটলা করে আছে এখানে সেখানে। একেক গ্রুপে ১০-১২ জন করে হবে। ওদের চোখে মুখে কিশোর সুলভ সরলতটুকু অনুপস্থিত। বরং ঔদ্ধত্য, বেপরোয়া, ভাবলেশহীন, অন্ধকারের হাতছানি আলিঙ্গন করার উন্মাদনা আছে।

আরও পড়ুন >>> আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে? 

একদল মোবাইল দেখছিল। ওদের বয়স বড় জোর ১৩/১৪। পনের-ষোল বছর বয়সীদের গ্রুপটা থেকে একজন উঠে এসে একজন কিশোরকে ডেকে কী যেন সামান্য কথা বলল। তারপরেই কান ফাটানো চড় বসিয়ে দিল। ছিটকে গেল ছোটজন। আমি তো সেই গোবেচারা সাধারণ মানুষ। বিপদ দেখে সরে পড়তে পারি না।

সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম কিশোরদের সামনে। সমস্যা কী, মারলেন কেন ছেলেটাকে? পনের-ষোল বছরের কিশোর বলে উঠলো, এইসবে আইসেন না ম্যাডাম। মেজাজ গরম হয়ে গেল।

জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কোন স্কুলে পড়ো? কিশোরের উত্তর—নাম কমু, কিছু করতে পারবেন? পুরো জাতির গালে চড় কষিয়ে দিল যেন। সত্যিই, ওরাই তো আমাদের মিছিলের কণ্ঠস্বর।

যারা কিশোর গ্যাংয়ের নেতা হচ্ছে, যারা সদস্য হচ্ছে তারাইবা আসলে কারা? সমাজের কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে এরা?

ওদের তো আমাদের খুবই প্রয়োজন। ওদের যখন সভা সমাবেশে আমার মঞ্চের সামনে দেখছি তখন কেন আমি মেনে নিচ্ছি? কেন আমি কিংবা আমরা ওদের জায়গায় ওদের ফিরিয়ে দিচ্ছি না? কেন শিক্ষার্থীরা স্কুল বাদ দিয়ে কখনো নিজেরা বাইক চালিয়ে কখনো বড় ভাই, ছোট ভাইদের পেছনে চড়ে আপনার আমার মিছিল ভারী করছে? এবং সেটা নির্বিচারে প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন এতগুলো শিক্ষার্থী স্কুলে অনুপস্থিত, শিক্ষক মহাশয় তাহলে কী করেন? নাকি তিনিও নিরুপায়? আরেকটি বিষয় ভাবা দরকার, যারা কিশোর গ্যাংয়ের নেতা হচ্ছে, যারা সদস্য হচ্ছে তারাইবা আসলে কারা? সমাজের কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে এরা?

আরও পড়ুন >>> শিক্ষার ভিত শক্ত হবে কবে? 

একটা বিষয় খুব স্পষ্ট। অসম সমাজ এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ফলাফল আজকের এই কিশোর গ্যাং। আজকে বিশেষভাবে একটি কথা বলাই উচিত এবং বলতে পারতেই হবে‌‌, এই যে এমন একটি সমস্যা বা রোগ প্রতিরোধ না করে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তাকে সযত্নে লালন করে যাচ্ছি এবং করতে দিচ্ছি আমরা—তা বড় অশনি সংকেত।

আমাদের রোপিত বিষবৃক্ষ একদিন আমাদেরই মুণ্ডুপাত করবে। এই কথাটা যাদের খুব বেশি বোঝা উচিত তারা আসলে শুধু এই দেশকে ব্যবহার করে। এই দেশকে অস্থির করে রাখে, এই দেশে রাজনীতি করে এবং ব্যবসা করে। কিন্তু এই দেশে তাদের বীজ বপন করে না।

এই অশনি সংকেত এবং অনৈতিকতা উপলব্ধি করার পরও আগামীর বিপদ সম্ভাবনা জিইয়ে রাখলাম—আমরা এক নির্বোধ জাতি। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে গেলাম। এটিই বড় অপরাধ।

কাকলী প্রধান ।। আলোকচিত্রী