ছবি : সংগৃহীত

সে এক বিস্ময়কর সময়। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ১/১১-এর দুই বছরের সময়টাই অন্যরকম এক অন্ধকার সময় হয়ে আছে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিরাজনীতিকরণ, মানে রাজনীতি থেকে রাজনীতিকে দূর করা। 'মাইনাস টু' ফর্মুলা তো তাদের প্রায় ঘোষিতই ছিল। সেই অন্ধকার সময়ের এক ভোরে বাংলাদেশকে আরও অন্ধকার করে দিলো একটি খবর।

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে খবর পেলাম আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বাসভবন সুধা সদন ঘিরে রেখেছে পুলিশ। সম্ভবত ভোর ৫টা তখন। আমার বাসা তখন সেন্ট্রাল রোডে, অফিস উত্তরায়। আমি তখন সিএসবি নিউজে কাজ করি। রেডি হতে হতে ফোন করছিলাম। অফিসে ফোন করে অ্যালার্ট করলাম। সাথে খুঁজতে থাকলাম কাছাকাছি বাসা, এমন একজন প্রেজেন্টার।

কোনো নিয়মিত প্রেজেন্টারকেই ফোনে পেলাম না। পেলাম নওরোজ ইমতিয়াজকে। তার বাসা বনানী। বললাম, দ্রুত অফিসে যান। কিন্তু বৃষ্টি থাকায় তিনি বাইক নিয়ে বেরুতে পারছিলেন না। তাকে অপেক্ষা করতে বলে আমি গেলাম সুধা সদনে। সেখানে ফটোগ্রাফার জীবনের কাছ থেকে কিছু ফুটেজ নিয়ে ছুটলাম উত্তরায়। বনানী থেকে তুললাম নওরোজকে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন দিবসে 

রিপোর্টার উদয় হাকিম চলে গেলেন স্পটে। ফোনে সব রেডি করে অফিসের সামনে পৌঁছতে পৌঁছতে ৫টা ৫০ মিনিট। আমি গাড়ি পার্ক করতে করতে নওরোজ ৬টায় বুলেটিন শুরু করল। সেই বুলেটিন চললো টানা ৩টা পর্যন্ত। সুধা সদন থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে নেওয়া হয় পুরান ঢাকার কোর্টে।

সেখান থেকে আনা হয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ কারাগারে। সেনাশাসিত সরকার ব্যবস্থায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। তবু পথে পথে ছিল মানুষের ঢল। চিৎকার, স্লোগান, কান্নায় মন খারাপ হয়েছিল বাংলাদেশের। ১৬ জুলাইয়ের সেই কালো ভোর বাংলাদেশকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

আজ যে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, সেই ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার দায় বা কৃতিত্বও কিন্তু বিএনপিরই।

আজ যে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, সেই ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার দায় বা কৃতিত্বও কিন্তু বিএনপিরই। নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা বানাতে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানোর আইডিয়া কার্যকর করেছিল ব্যারিস্টার মওদুদ।

যদিও আওয়ামী লীগের আন্দোলনের তোড়ে সেই আইডিয়া ভেস্তে গিয়েছিল, কে এম হাসানেরও আর প্রধান উপদেষ্টা হওয়া হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ অন্য সব বিকল্প বাদ দিয়ে নিজেই প্রধান উপদেষ্টা বনে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকেন।

এটা ঠিক ১/১১ সরকারের আগমনে প্রাথমিকভাবে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। আওয়ামী লীগও সেই সরকারকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু সবার মোহ কাটতে বেশি সময় লাগেনি।

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাশাসিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার কিছুদিন পর ১৫ মার্চ শেখ হাসিনা অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্র যান। তা যেন সেই সরকারের জন্য সোনায় সোহাগা। শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন, তার জন্য নানামুখী চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

এমনকি সরকারিভাবে তার দেশে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একের পর এক মামলা করে শেখ হাসিনাকে ভয় দেখানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা ভয় পাওয়ার মানুষ নন।

দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে শেখ হাসিনা ঝুঁকি নিয়েও দেশে ফেরেন। দেশে ফেরেন ৭ মে। আর ৩ মে ‘আউট লুক’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অকুতোভয় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমাদের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আছে তার দায়িত্ব হলো জাতীয় নির্বাচন করা। কিন্তু তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা উচিত।’

এমনকি সরকারিভাবে তার দেশে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একের পর এক মামলা করে শেখ হাসিনাকে ভয় দেখানো হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা ভয় পাওয়ার মানুষ নন।

৭ মে দেশে ফেরা শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৬ জুলাই। মজার ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার ৫৮ দিন পর গ্রেপ্তার করা হয় সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। অনেকে বলেন, শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের যৌক্তিকতা প্রমাণে এবং রাজনীতিতে তথাকথিত ভারসাম্য দেখাতেই বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

দেশের প্রধান দুই নেত্রী সংসদ ভবন এলাকার বিশেষ কারাগারে। ক্যাঙ্গারু কোর্টও বসতো সংসদ ভবন এলাকাতেই। জনগণ তাদের খবর পেত ডাক্তার আর আইনজীবীদের কাছ থেকে। 

কারাগারে থাকার সময়ই শেখ হাসিনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্কয়ার হাসপাতালে এনে তাকে চিকিৎসাও দেওয়া হয়। সেই সময় চিকিৎসার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তার মুক্তির দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন ও দেশবাসীর আন্দোলন, আপসহীন মনোভাব এবং অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

দীর্ঘ ১১ মাস কারাবন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ জুন সংসদ ভবন এলাকার বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি পান শেখ হাসিনা। তা যেন অন্ধকার সময়ে আলোর মুক্তি, গণতন্ত্রের মুক্তি।

মুক্তি পেয়েই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যান তিনি। ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর দেশে ফিরলে স্থায়ী জামিন দেওয়া হয় তাকে। পরে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি তার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠিত হয়।

চাইলে সবকিছু থেকে আপনি কিছু না কিছু ইতিবাচক দিক খুঁজে পাবেন। শেখ হাসিনার ১১ মাসের কারাজীবনও শেষ বিচারে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছে। বাইরে ব্যস্ত সময় কাটানো শেখ হাসিনা নিভৃত কারাগারে দেশের কথা ভেবেছেন, মানুষের কথা ভেবেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে আজ অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে গেছে তার প্রাথমিক পরিকল্পনাটা শেখ হাসিনা করেছিলেন কারাগারে বসেই।

১/১১ সরকার বিরাজনীতিকরণ চেয়েছিল। শেখ হাসিনাকে কারাগারে রেখে মাইনাস করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছিল বলেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সফল।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ