ছবি : সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে, কারণ ছয় দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক মুক্তির একটি সংজ্ঞায়িত মুহূর্ত প্রতিনিধিত্ব করে।

জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৭ জুন যে ছয়টি দাবি তুলে ধরেছিলেন তার লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলা করা। ছয় দফার সেই আন্দোলন স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম নিশ্চিত করেছিল। আর এই কারণেই ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়ে থাকে।

এই ছয় দফা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপথ গঠন করতে, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে ও দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি কোথায়? 

ছয় দফা আন্দোলন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে পূর্ব পাকিস্তানের পদ্ধতিগত প্রান্তিককরণ এবং শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। বঙ্গবন্ধু এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতায়ন ও মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ছয়টি দাবির রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন।

এই দাবিগুলোর মধ্যে ফেডারেল সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, আর্থিক স্বায়ত্তশাসন, সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ছয় দফা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দিক ছিল আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালি জাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৭ জুন যে ছয়টি দাবি তুলে ধরেছিলেন তার লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলা করা।

সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় সরকারের কাছে কিছুটা হলেও ক্ষমতা হস্তান্তর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অঞ্চলগুলো তাদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় অধিকতর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন এবং তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবদান রেখেছে।

ছয় দফা আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সম্পদ বণ্টন। এই আন্দোলন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের ভারসাম্যহীনতা দূর করতে চেয়েছিল, যাতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন নীতি ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে।

অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং গ্রামীণ এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও চালু করা হয়েছে। যদিও অগ্রগতি হয়েছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এবং অনুন্নত অঞ্চলে সম্পদ বণ্টনে সম্পূর্ণ সমতা অর্জনে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল ছয় দফা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো পরিচালনায় বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিল।

বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতির পরবর্তী বিবর্তন দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্বেষণকে প্রতিফলিত করেছে। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশের রপ্তানি ভিত্তি বৈচিত্র্যময় হয়েছে। কয়েকটি প্রাথমিক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে এবং গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত বিস্তৃত হয়েছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, বিশেষ করে, রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, পণ্য বৈচিত্র্যের উন্নতি, পণ্যের গুণমান মান বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাণিজ্য বাধাগুলো মোকাবিলার মতো চ্যালেঞ্জগুলো অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর ছয় দফা আন্দোলনের প্রভাব খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। জাতির অর্থনৈতিক নীতি ও উদ্যোগের পরবর্তী বিবর্তন আন্দোলনের চেতনা প্রতিফলিত করেছিল।

বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেমন কৃষি, শিল্প এবং সেবা, যা উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রেখেছে। তবে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, এটি স্বীকার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন একটি চলমান প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশ বর্তমানে দারিদ্র্য, আয় বৈষম্য, দুর্নীতি এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোসহ ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করার জন্য, শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে, বিনিয়োগের প্রচার, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে এবং মানব পুঁজি বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

তবে, সরকারকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে যা সমাজের প্রত্যেক অংশ উপকৃত করবে, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

আরও পড়ুন >>> এই দুঃখ কোথায় রাখি? 

বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে ছয় দফা আন্দোলনের নীতিগুলো অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি আরও অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের আর্থিক সংস্থানের ওপর বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে পারে। সরকারকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির অর্জন গুরুত্ব দিতে হবে এবং সম্পদ বণ্টনে আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে উন্নয়নের সুফল দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে যায়।

বাংলাদেশের উচিত তার রপ্তানি ভিত্তি বৈচিত্র্যকরণ এবং তার শিল্পের প্রতিযোগিতার উন্নতি অব্যাহত রাখা। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নতি এবং দেশীয় ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একটি অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা। বৈশ্বিক বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত।

ছয় দফা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দিক ছিল আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি জোরদার ও সম্প্রসারিত করতে হবে যাতে আরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা যায়। আয়ের বৈষম্য অবশ্যই প্রগতিশীল কর নীতি এবং লক্ষ্যযুক্ত সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।

তাছাড়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, শাসনব্যবস্থার উন্নতি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার হবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির অন্বেষণে পরিবেশ রক্ষা অগ্রাধিকার দিতে হবে। টেকসই উন্নয়নের অনুশীলন গ্রহণ করতে হবে, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের প্রচার করতে হবে এবং পরিবেশের উপর শিল্পায়নের বিরূপ প্রভাবগুলো প্রশমিত করতে হবে।

সবুজ প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার নাগরিকদের জন্য আরও টেকসই এবং স্থিতিস্থাপক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।

আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার দ্বৈরথ 

উপসংহারে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে রয়ে যাবে অনন্তকাল যা রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

আন্দোলনের দ্বারা উত্থাপিত দাবিগুলো দেশের অর্থনৈতিক নীতিগুলোর গতিপথ নির্ধারণ করেছে এবং একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের চলমান প্রচেষ্টার মঞ্চ তৈরি করেছে। ফলে, দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেন সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলনের দ্বারা অনুসৃত নীতিগুলোর প্রতি আমাদের সকলের অবশ্যই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।

আর্থিক স্বায়ত্তশাসন জোরদার করে, সম্পদের বৈষম্য মোকাবিলা করে, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির প্রচার, এবং টেকসই উন্নয়ন অনুশীলন গ্রহণ করে, বাংলাদেশ এমন একটি ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারে যেখানে তার সব নাগরিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফল থেকে উপকৃত হতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর ছয় দফা আন্দোলনের প্রভাব একটি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত সমাজের জন্য বাংলাদেশি জনগণের সংকল্পের প্রমাণ। এই আন্দোলন শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিই তৈরি করেনি বরং দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের মঞ্চও তৈরি করেছে। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ মোকাবিলা করার জন্য একটি রোডম্যাপ প্রদান করেছে যা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে জর্জরিত ছিল।

ছয় দফা আন্দোলনের মূল দর্শন অনুসরণ করে বাংলাদেশ স্থিরভাবে এমন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারে যেখানে অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হবে, জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে এবং সকলের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।। অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়