১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের যতখানি উজ্জ্বল অভ্যুদয় ঘটেছিল, পরবর্তী সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণেই সেই ঔজ্জ্বল্য চেষ্টা করেও বাংলাদেশ আর ধরে রাখতে পারেনি। পাঠক হয়তো এই বাক্যটি পড়েই ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের নানা বিভ্রান্তি, মিথ, গল্প বা গত ৫০ বছর ধরে আমাদের মগজে ঢুকানো নানাবিধ গুজব কল্পনা করতে শুরু করবেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা কী, তাহলে আমার উত্তর হবে— ৫০ বছরেও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে আমরা সত্য ইতিহাসের নিরিখে বিচার করতে পারিনি। অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সমীক্ষা, যুদ্ধোত্তর একটি রাষ্ট্রের টিকে থাকার সংগ্রাম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তৎকালীন জনমনস্তত্ত্ব ইত্যাদি সূচকের মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে গবেষণা করতে পারিনি। হাতে গোনা কিছু কাজ হয়েছে বৈকি, কিন্তু সেগুলো হয় অপ্রতুল না হয় সাম্প্রতিক; অথচ রাজ্যের মিথ্যাচার রচনা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে নিয়ে।

বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ, খাদ্যশস্য ও কারিগরি সহযোগিতা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য।

আয়তনের বিচারে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, কিন্তু তার জনসংখ্যা অনেক। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অর্থনীতির ভৌত কাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। ফলে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ, খাদ্যশস্য ও কারিগরি সহযোগিতা নিশ্চিত করা।

অন্যদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে বড় বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এবং ব্রিটেনের মতো কিছু পুঁজিবাদী দেশ ছাড়া আর কেউ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। মুসলিম বিশ্ব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো পরাশক্তিগুলো মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে পরোক্ষভাবে জেনোসাইডে মদদ দিয়েছে। সুতরাং, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও এই পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিগুলো নানারকম সমীকরণ তৈরি করেছে। এই স্বীকৃতি অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল; কেননা সর্বাধিক সংখ্যক রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার দ্বারও উন্মোচিত হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য ও আদর্শিক ভিত্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল। এক, তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং দুই, মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা। মুজিবনগর সরকার তৎকালীন ভারত সরকারকে এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিল, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদর্শ হবে জোট নিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা (সূত্র: Singh, Sheelendra Kumar, Bangladesh Documents, vol. 2, pp. 581-582)।
১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়— এমন নীতির দ্বারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে।’ বাহাত্তরের সংবিধানে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার থেকে নিরস্ত্র থাকবে এবং পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য সচেষ্ট হবে।’

১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাইওয়ান; ১৯৭৩ সালের একই দিনে স্বীকৃতি দেয় লেবানন। অবশ্য এই স্বীকৃতির পেছনে ১৯৭২ সালের আফ্রো-এশীয় গণসংহতি সংস্থা’র (আপসো) সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পররাষ্ট্রনীতি দুটো পর্বে বিভক্ত। একটি মুক্তিযুদ্ধকালীন, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল। দ্বিতীয় পর্বে স্বীকৃতি আদায় তুলনামূলকভাবে সহজতর হলেও এজন্য বাংলাদেশকে যথেষ্ট উদ্যোগী হতে হয়েছিল। কারণ তখনও পাকিস্তান ও তার মিত্রশক্তির অপপ্রচার চলছে বিশ্বের নানা জায়গায়। অন্যদিকে চীন ও আমেরিকার বিরোধিতার পরও যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে এই দুই পরাশক্তির অনুগত রাষ্ট্রগুলো বৈরী মনোভাব পোষণ করত।

বাংলাদেশের তৎকালীন কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছে। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর বেশ কয়েকটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। চীন তাদের মধ্যে একটি; তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ছিল— সৌদি আরব, জর্দান, ইরান ইত্যাদি। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে, এই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে স্বীকৃতি আদায়ের যাবতীয় প্রস্তুতিও বঙ্গবন্ধু সরকারই সম্পন্ন করেছিল।

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করলেও নবগঠিত বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করার সামর্থ্য তাদের ছিল না। সামরিক সাহায্যের ক্ষেত্রে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলনামূলকভাবে উদার থাকলেও অর্থনৈতিক সাহায্যের বিষয়ে তাদের সহযোগিতা যথেষ্ট ছিল না। ফলে ১৯৭২ সালের শেষ থেকেই সাহায্য সংগ্রহের বিকল্প উৎস সন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল। কিন্তু তার আগেই তারা বাংলাদেশকে নানা ধরনের মানবিক সাহায্য প্রদান করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বাঁক বদল ঘটে ১৯৭৩ সালের শুরুর দিকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আবদুস সামাদ আজাদের স্থলাভিষিক্ত হন ড. কামাল হোসেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং তারপরই ড. হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরে আসেন। একই বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদেই বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতির বাঁক বদল করতে হয়— কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু বারবার উচ্চারণ করছেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ ও ‘সমবায় গঠন’- এর কথা। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ‘বাকশাল’ কর্মসূচিতে, যার মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত নিহিত ছিল।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটি জটিল আবর্তে এসে দাঁড়ায়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা পালন করে এবং স্বাধীনতার পর তারা পাকিস্তান কর্তৃক প্রচারিত বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় নীতি মুসলিম দেশগুলো ভালো চোখে দেখেনি। তবে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির দূরদর্শিতায় এই ব্যবধানগুলো ধীরে ধীরে কমে আসে।

১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাইওয়ান; ১৯৭৩ সালের একই দিনে স্বীকৃতি দেয় লেবানন। অবশ্য এই স্বীকৃতির পেছনে ১৯৭২ সালের আফ্রো-এশীয় গণসংহতি সংস্থা’র (আপসো) সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশে পাকিস্তানের চালানো গণহত্যার তীব্র নিন্দা করা হয় এবং সমবেত আরব রাষ্ট্রগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশ এই সংস্থার সদস্য হয়।

আজ বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে। গত ৫০ বছরে নানা উত্থান-পতন ডিঙিয়ে বাংলাদেশ আজ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মবিশ্বাসী পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করেছে। যদিও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো নির্মম জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমরা আদায় করতে পারিনি, কিন্তু সে লক্ষ্যেও কাজ চলছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিই স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত রচনা করেছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আজ আমরা পৃথিবীর বুকে সমাদৃত, কিন্তু ৫০ বছর আগে চূড়ান্ত সংকট মুহূর্তে এই স্বীকৃতিগুলো আদায়ের লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল, তার অভিসন্দর্ভ ভুক্তি প্রয়োজন।

মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার