ছবি : সংগৃহীত

৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা বিস্তারে, গবেষণার প্রচারে এবং বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় একাডেমিক কার্যক্রম এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে।

১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। বছরের পর বছর ধরে, এটি একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতি এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অন্যতম পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছে।

আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং স্বাধীনতার জন্য এর অবদান ইতিহাসে স্বীকৃত হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন শহীদ ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা।

১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দুকের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন তিনি। তার সেই আত্মত্যাগ সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট শিক্ষক হিসেবে ড. জোহা সেই সময় দেশপ্রেম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনার উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট শিক্ষক হিসেবে ড. জোহা সেই সময় দেশপ্রেম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনার উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে তার অটল উৎসর্গ বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও সবাইকে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করেছিল।

একাডেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধের সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা, সক্রিয়তা এবং সংহতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকবৃন্দ একইভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ড. জোহার প্রয়াণ স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং সার্বভৌমত্বের নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের দ্বারা করা আত্মত্যাগের প্রতীক। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তার অটল অঙ্গীকার শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের জন্য লড়াই করার আর্তনাদ হিসেবে কাজ করেছিল।

আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক? 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসারে এগিয়ে আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় অধ্যয়ন, কৃষি এবং প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরাল প্রোগ্রাম অফার করে। মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উন্নয়নে অর্থপূর্ণভাবে অবদান রাখতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞান দিয়ে সজ্জিত করছে।

গবেষণা-ভিত্তিক শিক্ষার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবন এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। যুগোপযোগী একাডেমিক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত বিকশিত বৈশ্বিক ল্যান্ডস্কেপের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুসজ্জিত গ্র্যাজুয়েটদের প্রস্তুত করে চলেছে বছরের পর বছর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শক্তিশালী গবেষণা সংস্কৃতি রয়েছে এবং অধ্যয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এর গবেষণা সুবিধা এবং নিবেদিত শিক্ষকবৃন্দদের স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এমন উদ্ভাবনী গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে উত্সাহিত করে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান এবং পরিবেশগত অধ্যয়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোয় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গবেষণা কেন্দ্র এবং ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত গবেষণার ফলে যুগান্তকারী আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং নীতিগত সুপারিশসমূহ বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে।আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা গবেষণার সক্ষমতা আরও উন্নত করেছে, জ্ঞান বিনিময় এবং আন্তসাংস্কৃতিক শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ততা এবং সামাজিক প্রভাবের গুরুত্ব স্বীকার করে। এটি সক্রিয়ভাবে কমিউনিটি আউটরিচ প্রোগ্রামগুলো প্রচার করে শিক্ষা এবং গবেষণার উদ্যোগগুলো ক্যাম্পাসের সীমানা ছাড়িয়ে প্রসারিত করেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়, সরকারি সংস্থা এবং অলাভজনক সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয়টি সামাজিক সমস্যা সমাধান করেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-মান উন্নীত করেছে এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি প্রচার করেছে।

আরও পড়ুন >>> বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কেন উন্নত হচ্ছে না? 

কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মতো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগগুলো এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নাগরিক সম্পৃক্ততার পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগিয়ে তুলেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য নেতৃত্ব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যারা জাতির কল্যাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

জাতীয় উন্নয়নে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বহুগুণ। এর স্নাতকরা একাডেমিয়া, গবেষণা, প্রশাসন, ব্যবসা এবং জনসেবাসহ বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছে, যা দেশের অগ্রগতিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র নেটওয়ার্ক একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে কাজ করছে। এর সদস্যরা সক্রিয়ভাবে নীতি প্রণয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সংস্কারে অংশগ্রহণ করছে।

তাছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি, পরিবেশ বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং ব্যবসায় অধ্যয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই গ্র্যাজুয়েটরা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোর উন্নয়নে অবদান রাখতে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিচালনা করতে সহায়তা করছে। 

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় উন্নয়নে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনো অনেক বেশি অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব এবং সরকারি সহায়তা।

যেহেতু আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করছে, বাংলাদেশে শিক্ষা, গবেষণা এবং জাতীয় উন্নয়নে এর গভীর প্রভাব স্বীকার করা অপরিহার্য। শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিশ্রুতি, গবেষণা-চালিত পদ্ধতি এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের জ্ঞান ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় উন্নয়নে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনো অনেক বেশি অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব এবং সরকারি সহায়তা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যেসব ক্ষেত্রে অচলাবস্থা রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে প্রশাসনের শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ 

অনেক শিক্ষকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভঙ্গের একটি প্রবণতা রয়েছে। সেই প্রবণতা রুখতে হবে। যারা গবেষণায় অবদান রাখছেন তাদের সম্মানিত করতে হবে এবং যারা গবেষণাবিমুখ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

পরিশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ প্রচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। যে নীতির জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে এই বিশ্ববিদ্যালয় বদ্ধ পরিকর।

বাংলাদেশ যত এগিয়ে যাচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের অদম্য চেতনার জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এবং দেশের ভাগ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রত্যাশা এই বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে আরও বেশি ভূমিকা পালন করবে।

ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।। অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়