ছবি : সংগৃহীত

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন একঝাঁক তাজা প্রাণ ঝরছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ৭১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮২ হাজার ৫০৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ভর্তি হয়েছে ৯ হাজার ৫৬ জন। তাদের মধ্যে মেয়ে শিশু ৩১ শতাংশ এবং ছেলে শিশু ৬৯ শতাংশ। (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০২৩)

প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দশের বেশি। ডেঙ্গুর এই তীব্র প্রকোপ অক্টোবর পৰ্যন্ত বিদ্যমান থাকতে পারে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০০ বা ১০০০ কিংবা তার বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে প্রায় ৭ গুণ বেশি। এদের প্রায় ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে এবং ৮০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে।

যাদের মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও আছে। ডেঙ্গুর হাত থেকে যেন কারও নিষ্কৃতি নেই। এরা প্রত্যেকে ছিল এক একটি পরিবারের স্বপ্ন, আশা এবং ভরসা। এদের মৃত্যুতে তাদের পরিবারের স্বপ্ন, আশা এবং ভরসা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কি কোনো ভাবান্তর আছে?

আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

সমাজ এবং রাষ্ট্রের চোখে এরা নিছক কিছু সংখ্যা। তাই বিশাল জনসংখ্যা থেকে ৩০০ বা ৫০০ কিংবা ১০০০ কমে গেলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের ভাবান্তর হওয়ার কথা নয়।

ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের আহাজারিও আমাদের কর্ণ গহ্বরে পৌঁছাচ্ছে না। এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও কোনো সামাজিক আন্দোলন না হওয়ায় প্রমাণ করে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা এখন আমাদের আকর্ষণ করে না।

করোনা মহামারির সময়েও যতটুকু সামাজিক দায়বদ্ধতার উদাহরণ দেখা গিয়েছিল এখন তাও নেই। আসলে আমরা অনুভূতিহীন আত্মকেন্দ্রিক জীবে পরিণত হয়েছি।

ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের আহাজারিও আমাদের কর্ণ গহ্বরে পৌঁছাচ্ছে না। এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও কোনো সামাজিক আন্দোলন না হওয়ায় প্রমাণ করে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা এখন আমাদের আকর্ষণ করে না...

অন্যদিকে, ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম নয়। ২০২৩ সালে মৃত্যু হারের ঊর্ধ্বগতি, চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয়, পথ্য, যাতায়াতসহ অন্য  ব্যয়ের ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক ক্ষতি এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী যা ছিল ৪০০ কোটি টাকার বেশি। জনগণ প্রতিবছর এই ধরনের বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন  হলেও, রাষ্ট্র এবং নগর কর্তৃপক্ষসমূহের ডেঙ্গু নিরসনের প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতো নয়। বরং তারা বিভিন্ন সময়ে আসল কাজের পরিবর্তে নানা তামাসায় ব্যস্ত।

ডেঙ্গু যেহেতু আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নানা অনাচারের ফসল এর নিয়ন্ত্রণেও তেমন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সর্বমহলকেই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তা করতে না পারলে আর পালাবার জায়গা থাকবে না, কেননা ডেঙ্গু এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে। 

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব? 

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন মহল হয়তো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা ভাবছে। যেমন ইসলামী ফাউন্ডেশন ইমাম এবং  মসজিদ কমিটিকে কাজে লাগিয়ে মসজিদ এবং মসজিদ প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করার কথা ভাবছে। এই কার্যক্রম নিয়মিতভাবে করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় তা নিশ্চয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। মসজিদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের আশেপাশে ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রম চালাতে পারে।

অনুরূপ উদ্যোগ স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস-আদালত এবং সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা গ্রহণ করলে নিশ্চয় আরও বেশি ফলদায়ক হবে।

ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম নয়। ২০২৩ সালে মৃত্যু হারের ঊর্ধ্বগতি, চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয়, পথ্য, যাতায়াতসহ অন্য  ব্যয়ের ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক ক্ষতি এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তবে এই কাজটি করতে হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত সব জনবল সম্পৃক্ত করে। যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে ডেঙ্গু  নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আয়োজিত কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ গ্রহণ করবে তারা নিশ্চয় তাদের বাসাবাড়িতে এডিস মশা নিমূলে পরিবারের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করবে।

এভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে যা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আশু এবং সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করবে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই আমাদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

করোনার সময়ে বুঝে হোক আর না বুঝে হোক বেশকিছু হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যার মধ্যে সবচেয়ে বড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা। এই ভুলের মাশুল জাতিকে দীর্ঘকালব্যাপী দিতে হবে।

আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ 

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হিসেবে সেই একই ভুলের দিকে যেন আর পা না বাড়াই। যদি কোনো মহলের মাথায় এই চিন্তা আসে তাদের নিবৃত থাকার অনুরোধ করছি।

বরং আসুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই শিক্ষার্থী-শিক্ষকবৃন্দ মিলে ডেঙ্গু মশা এবং এর লার্ভা নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। আর বরাবরের মতো দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজে নেতৃত্ব দিক এটাই জাতির প্রত্যাশা।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক