ছবি : সংগৃহীত

তিনি শুয়ে আছেন। নিমীলিত আঁখি। নিথর দেহ। ফুলে ফুলে ঢাকা তার শরীর। তিনি ফুল ভালোবাসতেন। শিশুদের ভালোবাসতেন। ফুল ও শিশুর মধ্যে সুগভীর মিল রয়েছে। উভয়েই বিশাল সম্ভাবনাকে অন্তরে ধারণ করে বিকাশোন্মুখ। তার পাশে আজ শিশুরাও এসেছে। তাদের পরনে সাদা পোশাক। গলায় লাল স্কার্ফ বাঁধা। এই পোশাক তিনি খুব পছন্দ করতেন। জীবনে অজস্রবার এই লাল স্কার্ফ গলায় জড়িয়েছেন।

ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত নিথর মানুষটির নাম সাইফুন্নাহার চৌধুরী। ডাক নাম পান্না। মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন শহীদুল্লা কায়সার নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে। শহীদুল্লা কায়সার প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সর্বোপরি মানবমুক্তির প্রয়াসে উৎসর্গকৃত এক মহৎপ্রাণ। তিনি স্বনামে পরিচিত।

১৯৬৯ সালের ২৭ মে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি হয়ে উঠেন পান্না কায়সার। সাইফুন্নাহার চৌধুরী হারিয়ে যায় দাপ্তরিক দলিল দস্তাবেজের ভেতর। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বাঙালির ইতিহাসের এক বেদনাবিধুর কালোদিন। এই দিনে কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর বর্বর সদস্যরা তুলে নিয়ে যান শহীদুল্লা কায়সারকে। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।

আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন 

তাকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। একুশ বছরের একজন তরুণ নারী বিয়ের অল্প সময় পরেই সাথীহারা হলেন। তার কোলে তখন দুটি শিশু। বড়টি শমী কায়সার এবং ছোটটি অমিতাভ কায়সার। শমী কায়সার পরবর্তীকালে খ্যাতিমান অভিনেত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।

১৯৭৩ সালের একদিন। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের আদর্শিক বন্ধুরা তাকে জাতীয় শিশুকিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’-এ নিয়ে এলেন। অনেকের সাথে পরিচয় হলো। পান্না কায়সার খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হলেন। শুরু হলো নতুন অভিযাত্রা। প্রতিটি মা তার সন্তানকে অপরিমেয় ভালোবাসেন।

যদি শিশুদের অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সমাজ পরিবর্তনের কাজটি সহজতর হবে। এই ভাবনা থেকে তিনি খেলাঘরে আত্মনিবেদন করেন।

পান্না কায়সারের বাচ্চা দুটোর বয়স তখন চার ও তিন বছর মাত্র। আপন সন্তান এবং খেলাঘরের শিশুদের মধ্যে মা পান্নার ভালোবাসা একাকার হয়ে প্লাবিত জল লহরীর মতো ছড়িয়ে যেতে থাকল। তখন তিনি আর পান্না কায়সার নন, হয়ে গেলেন পান্না ভাবি। শুধু খেলাঘরে নয় সর্বত্রই তিনি তখন পান্না ভাবি।

খেলাঘরের মধ্যে পান্না ভাবি তার আদর্শকে খুঁজে পেয়েছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার পরশপাথরের মতো মানুষ ছিলেন। তার সাহচর্যে পান্নার চেতনায় একটি মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় তৈরি হয়েছিল। যদি শিশুদের অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সমাজ পরিবর্তনের কাজটি সহজতর হবে। এই ভাবনা থেকে তিনি খেলাঘরে আত্মনিবেদন করেন।

আমি খেলাঘরের সাথে যুক্ত হই ১৯৭৫ সালে। কিন্তু পান্না ভাবির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে ১৯৭৬ সালে। খেলাঘরের একটি গান আছে—‘আমরাতো সৈনিক শান্তির সৈনিক অক্ষয় উজ্জ্বল সূর্য / সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা আমরাতো জীবনের তূর্য / ...আমরাতো আজ তাই হাতে হাত রেখে ভাই / মিলেছিতো শান্তির লক্ষ্যে / আমাদের পতাকায় মুক্তির বারতা লেখা আছে রক্তিম সখ্যে।’

এই গানটির সাথে খেলাঘরের সবাই গলা মিলিয়ে থাকে। আমরা অনেকে মনে করতে পারি পান্না ভাবি তন্ময় হয়ে সমস্ত দেহ-মন দিয়ে গানটি গাইছেন। যেন এক গভীর প্রার্থনায় নিমগ্নসত্তা।

আরেকটি খেলাঘরের গানে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে কণ্ঠ মেলাতেন। সেটা হচ্ছে—‘সেতু গড়ি চলো সেতু গড়ি / মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে সেতু গড়ি।’ মূলত এই গান দুটির শব্দে শব্দে যে জীবনাদর্শের বাণী উচ্চারিত হয়েছে তা তার আপন আদর্শের মূর্তরূপও বটে।

আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে

খেলাঘরের জাতীয় সম্মেলন একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। সারা দেশ থেকে কয়েকশ শাখা আসরের ভাইবোন ও প্রতিনিধিবৃন্দ জড়ো হন। দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে তাদের সবার থাকাখাওয়ার ব্যবস্থাসহ অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়।

খেলাঘর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এটি কোনোধরনের এনজিও নয়। নিজেদের পকেটের টাকা এবং শুভানুধ্যায়ীদের দেওয়া অর্থে খেলাঘরের কর্মকাণ্ড চলমান থাকে। প্রতিটি জাতীয় সম্মেলনে বেশকয়েক লাখ টাকার দরকার হয়। অন্যদের কাছে যাই হোক খেলাঘরের জন্য এই অর্থ জোগাড় করা রীতিমতো কঠিন কাজ। দেখা যেত অধিকাংশ জাতীয় সম্মেলনে অর্থ উপ-পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন পান্না ভাবি। এই দায়িত্বকে সবাই কঠিন মনে করলেও তিনি হাসিমুখে কাজটি তুলে আনতেন।

তিনি পেশাগত জীবনে কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ভাবি ছিলেন বহুকর্মা মানুষ। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।

পান্না ভাবি ছিলেন বহুকর্মা মানুষ। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার লেখার মূল উপজীব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার জন্য তিনি ২০২১ সালে সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো—‘মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে (১৯৯১)’, ‘মুক্তি (১৯৯২)’, ‘নীলিমায় নীল (১৯৯২)’, ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ (১৯৯৩)’, ‘মানুষ (১৯৯৪)’, ‘অন্য কোনখানে (১৯৯৪)’, ‘রাসেলের যুদ্ধযাত্রা (১৯৯৪)’, ‘আমি (১৯৯৪)’, ‘অন্য রকম ভালোবাসা (১৯৯৫)’ প্রভৃতি।

অনেককিছুর সাথে সংযুক্ত হলেও আপাদমস্তক তিনি ছিলেন খেলাঘরের মানুষ। ১৯৭৩ সালে খেলাঘরের সাথে তার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল তার সমাপ্তি হলো ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট সকালে। চার আগস্ট ছিল শুক্রবার। সেইদিনও সকাল দশটায় খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করার কথা ছিল তার। কিন্তু এই খেলাঘর নিয়ে তার বুকে সুগভীর ক্ষত ছিল।

আরও পড়ুন >>> সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক 

১৯৯০ সালে খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির কতিপয় সদস্যের পদের লোভ ও জেদের কারণে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভাজিত হয়। ফলশ্রুতিতে সংগঠনটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই ঘটনায় খেলাঘরের প্রতিটি ভাইবোন, কর্মী-সংগঠক প্রচণ্ড আহত হয়। তিনি বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে আমৃত্যু একটি অংশের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

শহীদ মিনারের উদার আঙিনায় নিথর শুয়ে আছেন তিনি। শোকার্ত শহীদ মিনার। বিপুলসংখ্যক স্বজনেরা চোখে অশ্রু, হাতে ফুল নিয়ে ছুটে এসেছেন। তার ফুল্ললিকা দেহ কফিনবন্দি। কফিনটি ঢেকে দেওয়া হয়েছে খেলাঘরের পতাকা দিয়ে।

শোকার্ত খেলাঘরের ভাইবোনেরা। তাদের পরনে সাদা পোশাক গলায় লাল স্কার্ফ। এই লাল স্কার্ফ শত শত বার তিনি গলায় পরেছেন। বড় প্রিয় ছিল এই স্কার্ফ।

যখন খেলাঘরের ভাইবোনেরা প্রিয় ভাবিকে অন্তিম অভিবাদন জানাচ্ছেন তখন শহীদ মিনার নীরবতায় মগ্ন। ফুলে ফুলে ঢাকা, খেলাঘরের পতাকা আচ্ছাদিত প্রাণহীন দেহের স্বরযন্ত্র থেকে নীরব ভাষায় যেন ভেসে এলো—‘বিভাজন দূর করে তোমরা একত্রিত হও। শিশুর কলকাকলিতে ভরে উঠুক খেলাঘরের আঙিনা। সহস্র শিশুর হাসিতে আমি ফিরে ফিরে আসবো’।

লেলিন চৌধুরী ।। প্রেসিডিয়াম সদস্য, খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি