ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রথম চাহিদাই এখন বিসিএস। যেন অন্য বিষয়ে কারও কোনো আগ্রহ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে এখন যারা পড়তে আসে, তাদের বেশিরভাগই বিসিএস প্রার্থী। পড়তে আসা গবেষকের সংখ্যা খুবই কম। তা থেকেই বোঝা যায় বিসিএসের প্রতি শিক্ষার্থীরা কতটা ঝুঁকেছে।

কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কতজন বিসিএসে ক্যাডার হয়েছে তার একটা তালিকা ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যদিও এই তথ্যের সত্যতা কেউ নিশ্চিত করেনি। সেইখানে দেখলাম, ৪১তম বিসিএস-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন ৩৭৫ জন (১.২৪ শতাংশ)।

বিশ্ববিদ্যালয় কেমন তার একটি বড় ইনডেক্স হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কত সংখ্যক আছে। অর্থাৎ গাছ কী ফলেই পরিচয়। যেমন—আমেরিকার অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোগান দেয় সেই দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

আরও পড়ুন >>> মহামারিতে তারুণ্যের সংকট ও সমাধান 

এক জরিপে দেখা গেছে যে, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিক্ষকের পিএইচডি হলো ২০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এইরকম কোনো জরিপ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্য দিয়ে করা ফলপ্রসূ কোনো কাজ হবে না কারণ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষক হিসেবে নেয়। ফলে আমেরিকার মতো এখানে এমন কোনো পরিসংখ্যান নেওয়া ফলপ্রসূ হবে না।

তবে বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খুব ভালো করছে। বিশেষ করে বুয়েটর গ্র্যাজুয়েটদের অনেকেই এখন আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি হিসেবে খুব ভালো করছে। যা নিয়ে আমি আশাবাদী।

একদিকে বিসিএসের জোয়ার অন্যদিকে শিক্ষকদের বেতন বা স্থায়ীকরণ নিয়ে মাঝে মাঝে দেখা দেয় আন্দোলন। সামান্য কটা বেতন বৃদ্ধির জন্য স্কুলের শিক্ষকরা আন্দোলন করে বিভিন্ন সময়। তাদের দাবি মানাতো দূরে থাক একটু সহানুভূতিও কেউ দেখায় না। স্কুলের শিক্ষকরা সামান্য কটা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানালে সরকারের টাকা নেই বলে গান শুরু হয়ে যায়। বড় অদ্ভুত এই বাংলাদেশ।

এমন গাড়ি-বাড়ি প্রিয় আমলা পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার জানা নেই। এইসব ক্ষমতা এবং বিলাসিতা দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম মাদকাসক্তের মতো বিসিএসে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে....

অথচ তার বিপরীত চিত্রও আমরা দেখি। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনকে যারা ঘষামাজা করতে পারবে তাদের গাড়ি দেওয়া কিংবা এখন বেশি বেশি হারে প্রমোশন মানে দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশে দুর্নীতির চাষাবাদ হবে না তো কী হবে? গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন এসেছে। নতুন গাড়ি কেনা বন্ধের সিদ্ধান্তের এক মাস না যেতেই কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি থেকে সরে এসেছে সরকার।

এটি পড়ার পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। যখন দেশে একটা অর্থনৈতিক ক্রাইসিস চলছে যার ফলে খোদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল যে, সরকারি অর্থে কোন কর্মকর্তা বিদেশ যেতে পারবে না, এমনকি আমাদের ভিসিরা এটিকে এক ধাপ বাড়িয়ে শিক্ষকদের ওপর নিয়ে যায়, শিক্ষকরা নিজ খরচেও বিদেশ যেতে পারবে না তখন বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে বিলাসবহুল গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত সরকার কীভাবে নেয় বুঝলাম না।

আমাদের সরকারি আমলারা কি এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছে যে দেশের স্বার্থ না দেখে নিজেদের বিলাসিতার দিকেই কেবল তাদের নজর?

আরও পড়ুন >>> বিসিএস নির্ভর জাতি! 

আমরা শিক্ষকরা প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় মাইক্রোবাস বা মিনিবাসে। আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে যায়। অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে গাড়ি ধরি আবার ফেরার সময় গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা পথ হেঁটে বাসায় ফিরি। এই হাঁটাটাও শরীরের জন্য ভালো।

অনেক সহকর্মী একসাথে করে গাড়িতে যাওয়াও অনেকটা পিকনিক পিকনিক আনন্দের। এতে দেশের জ্বালানি সাশ্রয় হয়, কম তেল পোড়ানোর কারণে পরিবেশ কম দূষণ হয়, অনেকে একসাথে এক গাড়িতে যাওয়ার কারণে ট্রাফিক জ্যাম কম হয়, হেঁটে গিয়ে গাড়ি ধরা আবার ফেরার সময় গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা পথ হাঁটা শরীরের জন্য ভালো।

এত ভালো রেখে আমরা কেন বেশি সিসির দামি গাড়িতে চড়ে বেশি তেল পোড়াব? বিশাল গাড়িতে একা গিয়ে ট্রাফিক জ্যাম বাঁধাব? অতিরিক্ত সরকারি ড্রাইভার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ বাড়াব? দূষণ বাড়াব?

পৃথিবীর দ্বিতীয় আরেকটি দেশের নাম বলুন তো যেই দেশের সরকারি আমলারা এত রাক্ষুসে সরকারি গাড়ি দিয়ে, সরকারি তেল পুড়িয়ে ও সরকারি ড্রাইভার দিয়ে চালিয়ে অফিস করে?

বিসিএসের কারণে বেসরকারি খাতে বেশি বেতনের উচ্চ পদের চাকরিও তরুণদের কাছে চাকরি মনে হয় না। এইসব পদ পূরণ করার জন্য বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাকেও দেখেছি ভারতে তৈরি গাড়ি অ্যাম্বাসেডর দিয়ে চলাচল করতেন। আমি প্রতিবছর একাধিকবার ভারতে যাই। ভারতে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। আমি দেখেছি এবং তাদের কাছ থেকে জেনেছি ভারতের আমলারা সরকারি টাকায় রাক্ষুসে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে অফিসে যায় না। ইউরোপের আমলারা ট্রেন, বাস কিংবা বড়জোর নিজ খরচে কেনা নিজের গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে অফিসে যায়।

এমন গাড়ি-বাড়ি প্রিয় আমলা পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার জানা নেই। এইসব ক্ষমতা এবং বিলাসিতা দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম মাদকাসক্তের মতো বিসিএসে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে বিসিএস দেয়। এর মধ্যে চাকরি পায় কতজন? যারা পায় তাদের মধ্যে কতজন কাঙ্ক্ষিত ক্যাডারটি পায়? এক শতাংশেরও কম।

আরও পড়ুন : বিসিএস : মেধাবীরা কেন মাঠে? 

বিসিএসের কারণে বেসরকারি খাতে বেশি বেতনের উচ্চ পদের চাকরিও তরুণদের কাছে চাকরি মনে হয় না। এইসব পদ পূরণ করার জন্য বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

শুধু তাই না। লাইব্রেরিগুলোয় এখন বিসিএস পরীক্ষার্থী ভিড়, আবাসিক হলগুলোয়ও নিয়মিত ছাত্রদের পড়ার সুবিধা নেই বললেই চলে। এতে উচ্চশিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নিয়মিত ছাত্ররা নিয়মিত ক্লাস এবং ক্লাসের পড়ালেখা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বর্ষ থেকেই বিসিএসের জন্য পড়াশোনা শুরু করে যার ফলে অনেকেই অনার্স-মাস্টার্সে ভালো ফলাফল করতে পারছে না। এইসব সমস্যা কি আমরা আদৌ আমলে নিয়ে সমাধান করার কথা ভাবছি?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়