ছবি : সংগৃহীত

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। ১৫ আগস্ট রাত ৪টা ১৭ মিনিট থেকে ৫টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ৯৮ মিনিটের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব-দম্পতির তিন পুত্রসন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, দুই নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা ও রোজী, কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অমূল্য সব প্রাণ ঝরে যায়।

১৫ আগস্ট প্রভাতে বাঙালি জাতি এক বেতার ঘোষণায় জানতে পারে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন। ইথার তরঙ্গে মেজর ডালিম নামধেয় এক জঙ্গি সেনার ঘোষণা একটু পরপর শোনা যায়—‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’

মুহূর্তে গোটা জাতি স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সব নেতা হয় ধৃত, নয় আত্মগোপনে চলে যান। ইতিহাসের এই কালো কাহিনি অনেকেই লিপিবদ্ধ করেছেন, কিন্তু প্রাথমিক স্তব্ধতা কাটিয়ে ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি কিংবা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা যে উল্লাস প্রকাশ করে, তার বক্তব্য সামান্যই লিপিবদ্ধ আছে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সত্যিই বেদনাদায়ক 

১৫ আগস্ট সকালের কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবে না। এক অকৃতজ্ঞ জাতির সীমাহীন নির্লজ্জতার সাক্ষী হয়েছি সেইদিন। আমি তখন খুলনা শহরের মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজের সামনে এক দরিদ্র হিন্দু বাড়িতে ভাড়া থাকি। ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। পাশের দ্বিতলবাড়িতে সেইদিন উচ্চ হাস্যরব শুনতে পায়—যেন কী এক হাসির খবরে তারা আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না। তার এক ভাই বিএল কলেজে মাস্টার্সের ছাত্র—নিরীহ রাজনীতিবিমুখ। মন স্বভাবতই খারাপ। বেলা ১১টার দিকে এক ভিখারি এলো ভিক্ষা নিতে। তাকে তার ভাই বললেন, ‘জানো, শেখ সাহেবকে হত্যা করা হয়েছে।’ তার ত্বরিত জবাব, ‘আল্লায় বাঁচাইছে।’

ঠিক একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা, আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তখন ছোটবোন রেহানা ও পুত্র জয়কে নিয়ে জার্মানিতে স্বামীর কাছে। ওই বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আগের দিন রাতে যারা আমাদের ক্যান্ডেললাইট ডিনারে আপ্যায়িত করেছে, পরের দিন তারাই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’

১৫ আগস্ট রাতে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী আবদুর রহমান শেখ ওরফে রমার জবানিতে শুনে নেওয়া যাক সেই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তার জবানবন্দি হুবহু তুলে ধরা হলো—আমি ১৯৬৯ সালে কাজের লোক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৫টায় বঙ্গবন্ধু নিহত হন। তখন আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থাকতাম। ওইদিন অর্থাৎ ঘটনার দিন রাত্রে আমি এবং সেলিম দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের সামনে বারান্দায় ঘুমিয়েছিলাম।

আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং বলেন যে, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। ওইদিন তিনতলায় শেখ কামাল এবং তার স্ত্রী সুলতানা ঘুমিয়েছিল। ওইদিন শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী এবং ভাই শেখ নাসের দোতলায় ঘুমিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী এবং শেখ রাসেল দোতলায় একই রুমে ঘুমিয়েছিল। নিচতলায় পিএ মহিতুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মচারী ছিল।

বেগম মুজিবের কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি কিছু আর্মি ক্রোলিং করতে করতে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। তখন আমি আবার বাসায় ঢুকি এবং দেখি পিএ রিসিপশন রুমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। আমি পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় এসে দেখি বেগম মুজিব দোতলায় ছোটাছুটি করছে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : নেপথ্যের কুশীলব কারা?

আমি সাথে সাথে তিনতলায় যাই এবং ‘আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে’ বলে কামাল ভাইকে উঠায়। কামাল ভাই তাড়াতাড়ি একটা প্যান্ট ও শার্ট পরে নিচের দিকে যায়। আমি তার  স্ত্রী সুলতানাকে নিয়ে দোতলায় আসি। দোতলায় গিয়ে একইভাবে ‘আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে’ বলে জামাল ভাইকে উঠায়। তিনি তাড়াতাড়ি প্যান্ট-শার্ট পরে তার মা’র রুমে যান। সাথে তার স্ত্রীও যান। এই সময় খুব গোলাগুলি হচ্ছিল।

একপর্যায়ে কামাল ভাইয়ের আর্তচিৎকার শুনতে পাই। একই সময় বঙ্গবন্ধু দোতলায় এসে রুমে ঢুকেন এবং দরজা বন্ধ করে দেন। প্রচণ্ড গোলাগুলি একসময়ে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে আবার বাইরে এলে আর্মিরা তার বেডরুমের সামনে চারপাশে তাকে ঘিরে ফেলে। আমি আর্মিদের পেছনে ছিলাম। আর্মিদের লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ তারা বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

সিঁড়ির ২/৩ ধাপ নামার পরে নিচের দিক থেকে অনেক আর্মি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। গুলি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন। আমি তখন আর্মিদের পেছনে ছিলাম। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কী করো?’ উত্তরে আমি বলি, ‘কাজ করি।’ তখন তারা আমাকে ভেতরে যেতে বলে।

আমি বেগম মুজিবের রুমের বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিই। সেইখানে বেগম মুজিবকে বলি ‘বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছে।’ ওই বাথরুমে শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব ও বঙ্গবন্ধুর ভাই নাসের এবং আমি আশ্রয় নিই। শেখ নাসের ওই বাথরুমে আসার আগে তার হাতে গুলি লাগে, তার হাত থেকে তখন রক্ত ঝরছে। বেগম মুজিব শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে তার রক্ত মোছেন।

এরপর আর্মিরা আবার দোতলায় আসে এবং দরজা পিটাতে থাকলে বেগম মুজিব দরজা খুলতে যান এবং বলেন, ‘মরলে সবাই একই সাথে মরবো।’ এই বলে বেগম মুজিব দরজা খুললে আর্মিরা রুমের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং আমাকে নিচের দিকে নিয়ে আসছিল।

তখন সিঁড়িতে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’ এই কথার পর আর্মিরা তাকে দোতলায় তার রুমের দিকে নিয়ে যায়। একটু পরেই ওই রুমে গুলির শব্দ ও মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনতে পাই।

আর্মিরা নাসের, রাসেল ও আমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। সেইখানে সাদা পোশাকের একজন পুলিশের লাশ দেখি। নিচে নাসেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কে?’ তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরেই গুলির শব্দ ও তার ‘মাগো’ বলে আর্তচিৎকার শুনতে পাই।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

শেখ রাসেল ‘মার কাছে যাব’ বলে তখন কান্নাকাটি করছিল এবং পিএ মহিতুল ইসলামকে ধরে বলছিল, ‘ভাই, আমাকে মারবে না তো?’ এমন সময় একজন আর্মি তাকে বলল, ‘চলো তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যায়।’ এই বলে তাকে দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই কয়েকটি গুলির শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে পাই।

লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় সেলিমের হাতে এবং পেটে দুইটি গুলির জখম দেখলাম। এরপর দেখলাম কালো পোশাক পরিহিত আর্মিরা আমাদের বাসার সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। তখন ডিএসপি নুরুল ইসলাম এবং পিএ মহিতুল ইসলামকে আহত অবস্থায় দেখি। এরপরে আমাদের বাসার সামনে একটা ট্যাংক আসে।

ট্যাংক থেকে কয়েকজন আর্মি নেমে ভেতরের আর্মিদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে, ভেতরে কে আছে? উত্তরে ভেতরের আর্মিরা বলে, ‘All are finished.’ অনুমানিক বেলা ১২টার দিকে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর আমি প্রাণভয়ে আমার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় চলে যাই।

সেইদিন মন্ত্রী সেরনিয়াবাত (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি) এবং শেখ মনির (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে) বাড়িতে একই সঙ্গে আর্মিরা আক্রমণ করে। সেইখানেও রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। শেখ মনি নিহত হলো তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে। পিতামাতার মৃত্যু দৃশ্য শিশু তাপস দেখল খাটের নিচে বসে। কেবিনেট মন্ত্রী সেরনিয়াবাতকে হত্যা করা হলো তার দশ-পনের বছরের দুই কন্যা, এগারো বছর বয়সী এক পুত্র এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সী এক নাতির সঙ্গে।

ঘাতকের বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন অনেক আগে। বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

আজ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কারও কারও ফাঁসি হয়েছে; কারও কারও পলাতক জীবনে ঘৃণিত মৃত্যু হয়েছে; কেউ এখনো বিদেশে আত্মগোপন করে আছে। এর চেয়ে শাস্তি আর কী হতে পারে?

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যে নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন কাজ করে চলেছেন, দেশকে এশিয়ার উদীয়মান বাঘে পরিণত করেছেন, তাতেই ঘাতকশক্তির সমূহ পরাজয় চিহ্নিত হয়েছে।

তথ্যঋণ : দেয়াল, হুমায়ূন আহমেদ

নান্টু রায় ।। রাজনীতিক