ছবি : সংগৃহীত

সত্যিকারভাবে দেশ গড়ার জন্য যেই নেতৃত্ব দরকার সেইরকম নেতা এবং নেতৃত্বের দেখে মেলেনি অনেকদিন। ক্ষমতায় গিয়ে সবার মাথায় থাকে দলের কর্মীদের নিয়ে আলাদা দল গড়ার পরিকল্পনা; এই দলের মাধ্যমে তৈরি হয় দলান্ধতা, প্রশাসনে দলান্ধতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে দলান্ধতা।

যারা ক্ষমতায় গিয়েছে তাদের আমলনামা দেখুন। এরা যোগ্য মানুষদের মূল্যায়ন তো করেইনি উল্টো তাদের হেয় করেছে, দূরে সরিয়ে রেখেছে আর যতসব ধুরন্ধর দুর্নীতিবাজদের কাছে টেনেছে।

অজ্ঞ মানুষ যখন বিজ্ঞ মানুষের জন্য নির্ধারিত পদ পেয়ে যায় তখন তা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপদজনক হয়ে ওঠে। কারণ তখন তার মধ্যে বিজ্ঞের অভিনয় করার তাড়না আর ছলনা থাকে। সেই তাড়না ও ছলনা তাকে দিয়ে বেশি কথা বলায়। আর অজ্ঞ মানুষের বেশি কথা বলা মানেই ভুল আর মিথ্যায় পূর্ণ থাকবে। এই কথায় তখন তার অজ্ঞতার প্রমাণ বহন করবে। কাউকে তা প্রমাণ করতে হবে না।

আমাদের দেশের সর্বত্র সব সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ এটা। এরা বিজ্ঞের মতো অভিনয় করে বেড়াচ্ছে। সর্বত্র অজ্ঞ আর অমেধাবীদের দাপট। সৎ আর মেধাবীরা কোণঠাসা।

আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

এইসব দৃশ্যপট চেনার জন্য অন্যকিছু দেখতে হবে না। শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে একটু পরখ করে দেখেন তাহলেই বুঝতে পারবেন এরা অত্যন্ত সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের অযোগ্য এবং দলান্ধদের নিয়োগ দিয়েছে। একই সাথে শিক্ষায় বরাদ্দ যতটা সম্ভব কম দিয়েছে। আর ৩ বছর ধরে তো দেখছি, ক্রমাগতভাবে শিক্ষায় জিডিপির শতাংশে বরাদ্দ কমাতে কমাতে এখন ১.৭৬ শতাংশে এসে ঠেকেছে।

ওই দিকে ভিয়েতনামকে দেখুন। এখন ভিয়েতনামই হতে পারে আমাদের অনুকরণীয় মডেল। ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ওরা শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশের ওপরে বরাদ্দ দিয়েছে। তা এখন প্রায় ৪.৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। তার ফলও তারা পাচ্ছে।

২০০৮ সালেও সেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং-এ ১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে ছিল না এখন তাদের ২টি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে। অন্যদিকে আমাদের জার্নি ছিল উল্টো দিকে।

২০০৫ সালের দিকে বরং কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং (QS World University Rankings)-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৩৬৫! এইরকম অধঃপতনের পরেও এখনো আমাদের টনক নড়ছে না।

অজ্ঞ মানুষ যখন বিজ্ঞ মানুষের জন্য নির্ধারিত পদ পেয়ে যায় তখন তা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপদজনক হয়ে ওঠে। কারণ তখন তার মধ্যে বিজ্ঞের অভিনয় করার তাড়না আর ছলনা থাকে....

১৯৯০ সাল থেকে দিন যত এগিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি তত বেড়েছে। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনোনয়নে দলান্ধতাকে একাডেমিক যোগ্যতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নেমে গিয়েছে।

একই সাথে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রোমোশনের মানদণ্ডও নামানো হয়েছে। বিদেশ থেকে পিএইচডি করে একজন পোস্ট ডক আসলে তাকে নেওয়ার জন্য বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে যে মাত্র মাস্টার্স পাস করলো তাকে নেওয়ার আগ্রহ বেশি। এর কারণ অল্প বয়সের শিক্ষকদের রাজনীতিতে ঢুকানো, দলান্ধ বানানো সহজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্ররা কেমন থাকে একটু দেখে আসুন। পৃথিবীতে এমন আরেকটি দেশ খুঁজে পাবেন না, যেই দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এত মানবেতর জীবন যাপন করে। শিক্ষকরা ছাত্রদের অভিভাবক। এই সমস্যা সমাধানের জন্য অধিক বাজেট বরাদ্দের জন্য কোনো দাবি তারা করেছে?

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

আজকে যদি সব শিক্ষকদের নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট সমাধানের দাবি জানানো হয় বাংলাদেশের কোনো সরকার কি তা অবজ্ঞা করতে পারবে? যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সৃষ্টিসহ অনেক বিষয়ে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অমানবিক পরিবেশ দিয়ে সরকার কীভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন? বিলাসবহুল গাড়ি কেনেন? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের, যারা খুব শিগগিরই দেশের হাল ধরবে, তাদের মানবেতর পরিবেশে রেখে এইসব বিলাসিতা তারা কীভাবে করেন?

একটা দেশকে উন্নত করতে হলে প্রথমে সেই দেশের মানুষের মান উন্নত করতে হয়। মানুষের মান উন্নত করতে হলে সেই দেশের শিক্ষার মান উন্নত করতে হয়। শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উন্নত করতে হয়।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান উন্নত করতে সেই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মান উন্নত করতে হয়। শিক্ষকদের মান উন্নত করতে হলে সেই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, প্রমোশন নীতিমালা ও বেতন কাঠামো উন্নত করতে হয় যাতে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ও মননশীল মানুষেরা আসে।

এই গোটা প্রক্রিয়াটা একটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো যার ধারাবাহিক প্রভাব আছে। সমস্যা হলো, আমাদের দেশ যারা চালায় সেই রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই চেইন রিঅ্যাকশনটা বোঝার মানুষ নেই।

আমরা দেশের উন্নয়নের নামে কী করলাম? ঋণ করে ঋণের টাকায় অন্য দেশের প্রযুক্তি এবং অন্য দেশের দক্ষ জনশক্তি ব্যবহার করে স্যাটেলাইট পাঠালাম, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানালাম। দুনিয়াতে এমন আরেকটি দেশের উদাহরণ দিন তো যেই দেশের নিজস্ব বিজ্ঞানী নেই, নিজস্ব প্রযুক্তি অথচ ঋণ করে, ঋণের টাকা দিয়ে অন্য দেশের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী দিয়ে স্যাটেলাইট ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়েছে? আছে এমন উদাহরণ?

একটা দেশকে উন্নত করতে হলে প্রথমে সেই দেশের মানুষের মান উন্নত করতে হয়। মানুষের মান উন্নত করতে হলে সেই দেশের শিক্ষার মান উন্নত করতে হয়। শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উন্নত করতে হয়....

এইসব খাতে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে সেই টাকা যদি কেবল শিক্ষা খাতে (প্রযুক্তি খাতে নয়) বিনিয়োগ করতাম আজকে দেশে উন্নত মানের বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, প্রযুক্তিবিদ তৈরি হতো। তারা দেশ উন্নয়নের নতুন নতুন মডেল ও দর্শন দিত। তাদের তৈরি মডেলে চললে দেশ সত্যিকারের উন্নত হতো।

দেশে এখন উন্নত মানের দার্শনিক নেই, বিজ্ঞানী নেই, রাজনীতিবিদ নেই, প্রকৌশলী নেই, ডাক্তার নেই তাহলে আপনি কাদের দিয়ে দেশ উন্নত করবেন? সেই নেতৃত্ব কোথায়? এরা যে নেই তার একটা লিটমাস টেস্ট হলো দেশে বিবদমান ট্রাইবাল প্রকৃতির ঝগড়া। এত রুচিহীন কথাবার্তা কীভাবে বলে? ঝগড়া করারও তো একটা রুচিশীল ভাষা থাকতে হয়। এটা তো আর ২০০ বছর আগের পৃথিবী না।

আরও পড়ুন >>> ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম 

যারা ওপেনহেইমার (Oppenheimer 2023) সিনেমাটা দেখেছেন অথবা ম্যানহাটন প্রজেক্ট সম্বন্ধে জানেন তারা নিশ্চয়ই বোঝেন শিক্ষা ও গবেষণার গুরুত্ব কতটা! বিজ্ঞানীদের গুরুত্ব কতটা! ওপেনহেইমার তো আমেরিকান। তারপরেও ছাত্রাবস্থায় ও পরবর্তীতে তার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে সে দ্বিতীয়বার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পায়নি।

সাধারণত সেনসিটিভ এবং রিস্কি স্থাপনা কখনো বিদেশি বিজ্ঞানীদের দিয়ে বানানো হয় না। এখনো এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত আমাদের দেশি বিশ্বমানের একজন নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার নেই অথচ এইরকম একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষের দিকে। আর আমরা আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ফেলছি বিদেশিদের দিয়ে। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র আমার বাংলাদেশ।

এতকিছু জানার এবং বোঝার পর মনে হয়, কেন এইদেশে সঠিক নেতৃত্ব তৈরি হবে? কেন এই দেশে মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম বসু বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের মতো নেতৃত্ব তৈরি হবে? কেন এই দেশে বড় বিজ্ঞানী তৈরি হবে? কেন?

যতদিন পর্যন্ত আমরা শিক্ষাকে মেরামত করতে মনোযোগী না হবো ততদিন এই দেশে সত্যিকারের উন্নয়ন হবে না। সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে ধান্দাবাজ আর দুর্নীতিবাজে দেশ সয়লাব হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়