ছবি : সংগৃহীত

মানবতার ইতিহাসে কালো অধ্যায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। খুনিদের দায়মুক্তি দিতে তৎকালীন দখলদার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। পরে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এই আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়।

সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিল, যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়। পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেননি।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি 

মূলত, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে জেনারেল জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষাকারী এবং এই হত্যার ষড়যন্ত্রের মূল কুশীলবদেরই একজন। এই দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করেছিল খুনিদের প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা হলে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য এই আইন করা হয়েছিল।

তখন বাংলাদেশে সংসদ অধিবেশন না-থাকায় আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী হয়েও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোশতাক আহমেদ অধ্যাদেশ আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে এই আইন প্রণয়ন করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে খন্দকার মোশতাকই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে। আইনটি ১৯৭৫ সালের ৫০ নম্বর অধ্যাদেশ হিসেবে অভিহিত ছিল। ১৯৭৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয়।

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার আইনটি বাতিল করেন, ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ আবার খুলে যায়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে বাঙালি সংস্কৃতি 

উল্লেখ্য, এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়।

বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আব্রাহাম লিঙ্কন, মহাত্মা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, বন্দরনায়েককে হত্যা করা হলেও সেইসব দেশে ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি করা হয়েছিল। সংবিধান মানুষের অধিকারের রক্ষাকবচ।

পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে খুনিদের বিচার করা যাবে না। বাংলাদেশেই প্রথম ঘটেছিল, এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যার ২০ বছর পার হলেও কোনো রাষ্ট্রপতি বা সরকারপ্রধান তা বাতিল না করে উল্টো নিজেদের সুবিধা নেওয়ার জন্য ইনডেমনিটি বহাল রাখে। আমাদের জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা বাঙালিকে সেই কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছেন।

কুখ্যাত এই অধ্যাদেশে দীর্ঘ ২১ বছর দৃশ্যত থমকে ছিল আইনের শাসন। পরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনকে বৈধ বলে রায় দেয়। এরই পথ ধরেই দায়ের করা হয় মামলা। আইনের আওতায় আনা হয় খুনিদের। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ।

ইতিহাসের নৃশংস কালো অধ্যায়ের নেপথ্যে ছিলেন যারা, তাদের বিচার শুরু হতেও অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৪টি বছর। তবে দণ্ডপ্রাপ্তদের কয়েকজন এখনো পলাতক। সর্বশেষ ২০২০ সালে আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে ফাঁসি কার্যকর হয় ৫ খুনির।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ 

এই কথা সত্য যে, ইনডেমনিটির বিষয়টা এখনো অনেকের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। অনেকের কাছেই এখনো অজানা ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়। তাই ইতিহাসটি নতুন করে বলা প্রয়োজন।

জাতির পিতার খুনিদের মধ্যে এখনো পলাতক রয়েছে—খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান।

বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভয়াল দিনের কথা শেষ করা জরুরি। বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিদের রায় কার্যকর করা এখনও জাতির কাছে দায়। সেই দায় থেকে মুক্ত হওয়া সময়ের দাবি।

দুলাল আচার্য ।। সিনিয়র সাংবাদিক