ছবি : সংগৃহীত

কাতার এয়ারওয়েজ (Qatar Airways)-এর ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছে প্রায় ২ ঘণ্টা হয়ে গেল। প্রায় সাড়ে ৪ বছর পর হেলাল আজ কাতার থেকে দুই মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসলো। বাইরে তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান অপেক্ষা করছে কিন্তু সে বের হতে পারছে না কারণ এখানে প্রতিটা ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে।

ঢাকার যানজট পার হয়ে আসতে তাদেরও নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে। তার এই দেরির কিছু যৌক্তিক কারণ যে নেই তাও নয়। এই যে বিমান নামার পর প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো রানওয়েতে, কারণ ট্যাক্সিওয়ে খালি নেই। এই সময় অনেক বিমান আসা-যাওয়া করে তাই তাদের বহনকারী বিমানকে অপেক্ষা করতেই হলো।

এতদিন পর যারা দেশে আসে তারা আকাশ থেকেই মাটির গন্ধ পায়। তখন এক মিনিট অপেক্ষাকেও মনে হয় এক বছর। এরপর ইমিগ্রেশন পার করতেও অনেক সময়, কারণ যে কয়টি বুথ আছে তা দিয়ে এই ব্যস্ত সময়ে সবাইকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অফিসারদের।

তাও পার হয়ে এখন হেলাল বসে আছে লাগেজের বেল্টের সামনে। প্রায় ৪০ মিনিট হয়ে গেল এখনো সে তার লাগেজ বুঝে পেল না। সে গুণে গুণে দেখল আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য এখানে দুই টার্মিনাল মিলিয়ে মোট বেল্ট আছে মাত্র ৮টি যা কোনোভাবেই একটা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট এর জন্য পর্যাপ্ত না।

দোহা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Doha International Airport) থেকে তার পাশের সিটেই লাবিব নামের আরেক বাংলাদেশি পেয়ে যান, যিনি এখন ইউরোপের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তার সাথে টুকটাক কথা একসময় এসে পড়ল বিমানবন্দরের সুযোগ সুবিধা নিয়ে।

লাবিবের সাথে ইউরোপের আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ এয়ারপোর্টের কথা আর তার তুলনায় আমাদের এয়ারপোর্টের সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়েও বেশকিছু কথা হলো। নিজের দেশকে অন্য দেশের সাথে তুলনা করতে হেলালের কখনোই ভালো লাগে না কারণ শত হলেও এটা মাতৃভূমি। কিন্তু লাবিবের সাথে কথা বলে জানতে পারল যে, আমাদের দেশেও নাকি বিমানবন্দরকে আধুনিক করা হচ্ছে আর নতুন করে টার্মিনাল-৩ নামে একটা টার্মিনাল করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা বড় অংশ আসে কৃষি পণ্য ও টাটকা সবজি রপ্তানি করে। এতদিন পর্যন্ত আমাদের কার্গো ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ছিল বছরে প্রায় ২ লাখ টন প্রায়, যা নতুন টার্মিনাল চালু হলে প্রায় তিনগুণ (বছরে ৫.৭ লাখ টন প্রায়) বৃদ্ধি পাবে।

এরপর আরও অনেকক্ষণ তারা ঐ টার্মিনাল-৩ নিয়ে টুকটাক কথা চালিয়ে গেল আর হেলাল চেষ্টা করলো যতবেশি সম্ভব তথ্য মনে রাখতে যাতে যে দুই মাস পরে কাতার গিয়ে নিজের দেশের এই এগিয়ে যাওয়ার গল্পটা করতে পারে।

হেলাল খুব বেশি লেখাপড়া না করলেও এটা বুঝতে পারল যে, ঐ টার্মিনাল হলে অনেক দেশের বিমান কোম্পানি আমাদের দেশ থেকে বিমান অপারেট করবে। এতে করে বিমান ভাড়া কমে যাবে এবং বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের পণ্য ও যাত্রী পরিবহন আরও দ্রুত করা সম্ভব।

এটা একটি দেশকে পৃথিবীতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য খুব প্রয়োজন। ডিজাইন বা নকশা সম্পর্কে হেলাল খুব একটা কিছু বুঝে না কিন্তু এই টার্মিনাল-৩ যিনি নকশা করেছে, রোহানি বাহারিন (Rohani BAHARIN)। রোহানি, সিঙ্গাপুর চাঙ্গি বিমানবন্দর (Singapore Changi Airport)-সহ ভারতের সর্দার বল্লভভাই পটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Sardar Vallabhbhai Patel International Airport), পাকিস্তানের ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Islamabad International Airport)-সহ আরও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নকশা করেছে। তাই হেলাল মোটামুটি নিশ্চিত যে, আমাদের এই টার্মিনাল দেখতেও অনেক সুন্দর ও গোছানো হবে।

বিদেশের এয়ারপোর্টের সৌন্দর্যের গল্প শুনে তখনও সে বাংলাদেশের গল্প করতে পারবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা বড় অংশ আসে কৃষি পণ্য ও টাটকা সবজি রপ্তানি করে। এতদিন পর্যন্ত আমাদের কার্গো ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ছিল বছরে প্রায় ২ লাখ টন প্রায়, যা নতুন টার্মিনাল চালু হলে প্রায় তিনগুণ (বছরে ৫.৭ লাখ টন প্রায়) বৃদ্ধি পাবে।

এমনকি নির্মাণাধীন এই টার্মিনালে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা প্রায় ৪০০০ টন হবে যা মাছ, সবজি, ফলসহ অন্যান্য পচনশীল বস্তু রপ্তানিতে এতদিনের ধীরগতি ও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশ থেকে হেলাল যতবার কাতার আসা-যাওয়া করছে ততবার তার কাছে দুই দেশের দুই এয়ারপোর্টের চেক-ইন কাউন্টার আর বোর্ডিং ব্রিজ-এর তারতম্য চোখে লেগেছে। দোহা এয়ারপোর্টে চেক-ইন কাউন্টারের পরিমাণ এত বেশি যে সেইখানে ওয়েটিং টাইম কম আর সেইখানকার স্বয়ংক্রিয় কাউন্টারগুলো এখন ভালোভাবেই অপারেট করতে পারে।

তবে আজ তার এটা ভেবে ভালো লাগছে যে, এই থার্ড টার্মিনালে ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার, যার মধ্যে ১৫ টি সেলফ চেক-ইন আর ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ ডিপারচারে ইমিগ্রেশন কাউন্টার বসবে ৬৬টি আর এরাইভালে ৫টি অটোমেটিক চেক-ইন কাউন্টারসহ ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেক-ইন এরাইভাল কাউন্টার বসবে তখন আর তাকে দেশের মাটিতে নেমে প্রিয়জনের কাছে যেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।

এই টার্মিনালে বিশাল ভিভিআইপি স্পেস রাখা হবে যদিও হেলাল এটা নিয়ে এত বেশি ভাবছে না কারণ ভিআইপিরা সবসময় সেরা সুবিধাই পায় বরং তার কাছে যেটা ভালো লাগছে তা হলো এই টার্মিনালে নাকি ১০০০ এরও বেশি গাড়ি পার্ক করা যাবে আর এর সাথে ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর মেট্রোরেল এর সংযোগ থাকবে।

এই ধরনের বহুমাত্রিক যাতায়াত ব্যবস্থার ফলে সাধারণ যাত্রীরা নিরাপদে আর নির্বিঘ্নে দেশের বিভিন্ন দিকে যেতে পারবে, আর তখন হেলালের মতো কাউকে এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই গাড়ি ভাড়া করার ঝক্কি বা নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে না।

টার্মিনাল-৩-এ সব অত্যাধুনিক মেশিন আর যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে, এটা জরুরি কারণ বিমান বন্দরের যাত্রীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি, নিরাপত্তা আর স্বাস্থ্য ঝুঁকি আগে থেকেই চিহ্নিত করতে হলে আধুনিক যন্ত্রপাতির বিকল্প নেই।

রানওয়ে থেকে ট্যক্সিওয়েতে আসতে তার যে ৩০ মিনিটের অপেক্ষা তাও আর থাকবে না কারণ এখানে নতুন করে দুইটি হাই-স্পিড ট্যাক্সিওয়ে করা হচ্ছে। তবে জায়গার অভাবে রানওয়ের সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না যেটা আমাদের একটা দুর্বলতা থেকেই গেল।

নতুন টার্মিনাল-৩-এ সব অত্যাধুনিক মেশিন আর যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে, এটা জরুরি কারণ বিমান বন্দরের যাত্রীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি, নিরাপত্তা আর স্বাস্থ্য ঝুঁকি আগে থেকেই চিহ্নিত করতে হলে আধুনিক যন্ত্রপাতির বিকল্প নেই।

তাছাড়া বর্তমানে বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পারাপার হচ্ছে সেইখানে এই নতুন টার্মিনাল হলে যাত্রী পারাপার বছরে প্রায় ৩ গুণ বেড়ে যাবে। এত পরিমাণ যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে আধুনিক ও স্মার্ট সিস্টেমের বিকল্প নেই। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যারা গ্রাউন্ডসম্যান বা অফিসার থাকবে যাত্রীদের সাথে তাদের আচরণ ও ব্যবহার কেমন হবে তার প্রশিক্ষণ দিতে হবে, কারণ সবকিছু ছাপিয়ে দিনশেষে মানুষ মানবিক একটা বিমানবন্দর দেখতে চায়।

হেলালের লাগেজ বেল্টে দেখা যাচ্ছে, তার প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো আজ একটি লাগেজের জন্য। তবে এই সময়টা সে বিমানের পাশের সিটের বসা ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া থার্ড টার্মিনালের গল্পগুলো কল্পনায় দেখে নিতে পেরেছে আর ভাবছে নতুন টার্মিনালে যখন ১৬টা লাগেজ বেল্ট থাকবে তখন তাকে আর এভাবে অপেক্ষা করতে হবে না।

হেলাল পরিবার নিয়ে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে করে যাত্রাবাড়ীতে তার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। ৪ বছর আগে সে যখন বাসা থেকে এয়ারপোর্টে এসেছিল তখন যানজটের জন্য তার পৌঁছাতে সময় লেগেছিল প্রায় ৪ ঘণ্টা সেই কথা চিন্তা করে আজ সে মেয়ে দুটোকে আসতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু সে অবাক হয়ে জানল যে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে তার পরিবার মাত্র ১ ঘণ্টায় যাত্রাবাড়ী থেকে চলে এসেছে যেখানে মাত্র ১০ মিনিট লেগেছে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যখন এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাবে তখন ২০ মিনিটেই সে এয়ারপোর্ট চলে আসতে পারবে।

তাছাড়া বিআরটি, এমআরটি পুরোদমে চালু হলে বিমানবন্দর থেকে ঢাকা বা ঢাকার বাইরে যাতায়াত অনেক বেশি নিশ্চিত ও নিরাপদ হবে। হেলালের দুই মেয়ে তাকে দুই দিক দিয়ে জড়িয়ে আছে, আর হেলাল এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে নতুন এক ঢাকা দেখতে দেখতে বাসায় ফিরেছে। সুন্দর একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু দেশের মজবুত অর্থনীতির জন্যই প্রয়োজন তা কিন্তু নয় বরং এটা প্রিয়জনের কাছে নিরাপদে আরেকটু আগে আমাদের পৌঁছে দেয়।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস