ছবি : সংগৃহীত

শেখ রাসেল। ১০ বছরের মৃত্যুহীন এক প্রাণ। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো পঞ্চাশের অধিক। ১৯৬৪ সালের আজকে দিনে জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। রাত দেড়টার দিকে পৃথিবীর আলো বাতাসে আসে শেখ রাসেল।

বঙ্গবন্ধু সেইদিন ছিলেন চট্টগ্রামে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে চলছে দুর্বার আন্দোলন। উত্তাল সেই সময়ে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয় কনিষ্ঠ পুত্র আগমনের খবর।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মুগ্ধ পাঠক। প্রায়ই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছাকে বার্ট্রান্ড রাসেলের বই পড়ে শোনাতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গমাতাও হয়ে ওঠেন বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। সেই অনুযায়ী কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখেন রাসেল।

১০ বছরের জীবনে একজন মানুষকে কতটা বোঝা যায়? সত্যি বলতে গেলে আদতে বোঝা যায় না। কিন্তু শৈশবেই কিছুটা ইঙ্গিত মেলে আজকের শিশু ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলে কতটা জ্ঞানী হতে পারেন। কতটা মানবিক হতে পারেন। কতটা মেধাবী হতে পারেন। কতটা সৃজনশীল হতে পারেন। শেখ রাসেলকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেই পথে এগোনো যেতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান এবং নবীন সদস্য হিসেবে সবার আদুরে ছিলেন রাসেল। ভাইবোন, বাবা-মা, আত্মীয় পরিজনের কাছে ছিলেন খেলার পুতুল। যাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হতো। সবাই করতেনও তাই।

বুকের ওমে আগলে রাখতেন শেখ রাসেলকে। আর এসবের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মেলে ছোট্ট রাসেলের নানা মানবিক গুণাবলি। চোখে পড়ে তার মধ্যে থাকা অপার সৃজনশীলতা কিংবা আগামীর নেতৃত্বের নানা গুণ। চোখে পড়ে প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তার অসীম মায়ার চিত্র।

১০ বছরের জীবনে একজন মানুষকে কতটা বোঝা যায়? সত্যি বলতে গেলে আদতে বোঝা যায় না। কিন্তু শৈশবেই কিছুটা ইঙ্গিত মেলে আজকের শিশু ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলে কতটা জ্ঞানী হতে পারেন। কতটা মানবিক হতে পারেন...

জন্মের পর থেকে বাবাকে খুব একটা কাছে পায়নি রাসেল। একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধুর তখন সীমাহীন ব্যস্ততা। যতদিন মুক্ত থাকেন, পুরোটাই কাটে সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক ব্যস্ততায়। বাকিটা সময় কাটে জেলে, কারা প্রকোষ্ঠে।

সেই সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রাসেলও যেত কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ছোট্ট শিশু কি আর কারাগার আর মুক্ত বাতাসের বিভেদ রেখা অতটা বোঝে?

রাসেল থেকে যেতে চাইতো বাবার সঙ্গে। ফেরার সময় গলা জড়িয়ে কাঁদতো। বঙ্গবন্ধুর গলাও কি তখন ভারি হয়ে উঠতো না? ভিজে উঠতো না চোখের কোণ? ভাইবোনরা শেখ রাসেলকে বুঝিয়েছেন—কারাগার হলো বাবার বাড়ি। সবাই মিলে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। বেড়ানো শেষে নিজের বাড়িতে ফেরত যেতে হয়।

তারাও এখন ফেরত যাবে ধানমন্ডির নিজের বাড়িতে! বাড়ি ফিরেও রাসেল বাবার জন্য কাঁদতো। শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব তখন বলতেন, তাকেই যেন আব্বা বলে ডাকে রাসেল। সেই থেকেই মাকে আব্বা ডাকতো রাসেল!

ধানমন্ডির ৩২ বছরের বাড়িতে ছিল কবুতরের ঘর। কবুতর পোষা হতো গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতেও। কবুতর ছানারা ছিল রাসেলের খেলার সাথী। যেদিন থেকে কবুতর তার বন্ধু হলো সেইদিন থেকে আর কবুতরের মাংস খেত না রাসেল।

বন্ধুর মাংস কি বন্ধু খেতে পারে? একই রকম মায়া ছিল তার পোষা কুকুর টমির প্রতিও। বন্ধু টমি কেন ঘেউ ঘেউ করে তাকে বকা দেয় তা নিয়েও ছিল বিস্তর অভিমান।

ধানমন্ডির ৩২ বছরের বাড়িতে ছিল কবুতরের ঘর। কবুতর পোষা হতো গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতেও। কবুতর ছানারা ছিল রাসেলের খেলার সাথী। যেদিন থেকে কবুতর তার বন্ধু হলো সেইদিন থেকে আর কবুতরের মাংস খেত না রাসেল।

একাত্তরের ২৫ মার্চ। গ্রেফতার হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাত সাড়ে তিনটার দিকে মায়ের সঙ্গে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয় রাসেল। এরপরের অনেকগুলো মাস এই পরিবারটির কেটেছে উদ্বাস্তু জীবন। নিজ দেশে পরবাসীর মতো অবরুদ্ধ একটি শহরে সন্তান পরিজন নিয়ে অসহায়ের মতো ঘুরেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা।

অবশেষে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে ঠাঁই হয় তাদের। পাক হানাদারের অধীনে বন্দিজীবন। সেই সময় প্রায়ই গোপনে কাঁদতো রাসেল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতো—ময়লা পড়েছে চোখে। আজ এতদিন পর ভাবলে অবাক লাগে ছয় সাত বছরের একটি শিশু, এতটা বুঝদার কীভাবে হয়েছিল? কাঁদলে পরিবারের বড়দের কষ্ট আরও বাড়বে—সেই ভাবনায় চোখের জল লুকিয়ে রাখতো ছোট্ট শিশু!

১৯৭২ সালে রাসেল স্কুলে ভর্তি হলো। প্রথম শ্রেণিতে। এই সময় তাকে বাসায় পড়াতে আসতেন গীতালি দাশগুপ্তা। গীতালি যখন রাসেলকে পড়াতে যান তার কয়েক মাস পর ছিল বার্ষিক পরীক্ষা। কিছুদিন পড়ানোর পর রাসেলের প্রশ্ন তার শিক্ষককে—পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আপনি আর আসবেন না? মানুষকে কতটা মায়ায় বেঁধেছিল এই ছোট্ট শিশু?

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখ। শেখ রাসেলের মন খারাপের দিন। বড় শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা চলে যান জার্মানি। সঙ্গে নিয়ে যান ছোট্ট রাসেলের আরও ছোট্ট ভাগ্নে জয়কে। কিন্তু মন খারাপ করা রাসেল কি সেইদিন জানতো মাত্র কয়েক মাস পরেই আসবে এরচেয়ে আরও অনেক বেশি মন খারাপ করা দিন? এক নৃশংস বর্বরতায় থেমে যাবে ফুলের মতো পবিত্র একটি ছোট্ট শিশুর জীবন?

আজ শেখ রাসেলের জন্মদিন। দেশজুড়ে নানা আয়োজন। সভা সেমিনার। উদযাপন। এসবের মাঝেও আমরা যেন একটা বিষয় মাথায় রাখি, আজকের শিশু যাদের বয়স শেখ রাসেলের সমান তাদের যেন আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করি একজন মানবিক মানুষ হিসেবে।

শুধু প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার দিকে না যায়। আজকের শিশুদের যেন আমরা ছোট থেকেই জানানোর চেষ্টা করি বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস। যেন জানানোর চেষ্টা করি পূর্বপুরুষের কী অসীম আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

প্রতিটি শিশুর মনে যেন আমরা গেঁথে দিতে পারি আমাদের এই লাল সবুজ দেশটা কারও দানে পাওয়া নয়। অমিত তেজে লড়ে আমরা অর্জন করেছি একটি পতাকা। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি পৃথিবীর বুকে।

সব শিশুর মনে গেঁথে যাক দেশপ্রেমের বীজ। তাহলেই পাব আগামীর সৎ প্রজ্ঞাবান এবং দেশিপ্রেমিক মহীরুহ। জয় হোক সবার।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী