আমাদের শেখ রাসেল
দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় কত সংগ্রাম, কত রক্তস্রোত, কত বেদনা, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন সইতে সইতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হলো এদেশের বিজয়। বিজয়ের এই গৌরব আপামর জনতার সঙ্গে শিশুরাও অনুভব করছে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে যে সাহস আর সংগ্রামের ঝাঁঝালো প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে সেখানে এ দেশের শিশুরাও গৌরবের প্রতীক হয়ে মিশে আছে।
শিশুদের প্রতীক শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র। তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এখানে-ওখানে যাচ্ছেন। মানুষের দুর্দশার সঙ্গী হচ্ছেন। স্বপ্নের কথা বলছেন। দেশের কথা বলছেন। শিশুটি তার আঙুল ছুঁয়ে আছে। আমরা দেখতে পাই, বাঙালি ইতিহাসের এই মহানায়কের আঙুল ছুঁয়ে পায়ে-পায়ে হাঁটছে শিশু রাসেল। রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছুটছেন বাংলার নানা প্রান্তরে, কথা বলছেন আপামর জনতার সঙ্গে।
প্লেনে চড়ে গিয়েছেন বিদেশের রাজসভায়; সঙ্গে রাসেল। এটিই প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে শিশুর জন্য কী মায়াময় জায়গা ছড়িয়ে আছে। নিজের কনিষ্ঠ পুত্র বলে নয়, রাসেলকে সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধু কার্যত শিশুর জগৎ তৈরি করে দেওয়ার বাসনা পোষণ করেছেন। জনতার কোলাহলের মাঝে বেড়ে ওঠার শক্তি জোগাতে চেয়েছেন। রাসেলের মধ্য দিয়ে এ দেশের শিশুদের সঙ্গে ভালোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানান অনুষঙ্গ শেখ রাসেলের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তুলত।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখেন, ‘আব্বা যখন ৬-দফা দিলেন তারপরই তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল আব্বাকে খুঁজত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দি হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো।’
মহান মানুষেরা ভবিষ্যৎ দেখতে পান। ভবিষ্যতের জন্য সুনিপুণ কাঠামো তৈরির পরিকল্পনা করতে জানেন। ভবিষ্যৎ সাধক হিসেবে বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদেরও গড়তে হবে। তাদের ভেতরে জাগাতে হবে দেশপ্রেম। শিশুরা গড়ে উঠুক কল্যাণকামী ও সৌন্দর্যমূলক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। এমন সব দর্শনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে শেখ রাসেল হয়ে ওঠে তার আদরের পরশমণি।
বঙ্গবন্ধুর কাছে তার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ছিল বাংলাদেশের সব শিশুর প্রতীক। শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর।
বঙ্গবন্ধুর কাছে তার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ছিল বাংলাদেশের সব শিশুর প্রতীক। শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত। তার স্ত্রী বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিবকে প্রায়ই তিনি রাসেলের গল্প শোনাতেন। রাসেলের জীবনদর্শন বঙ্গমাতাকে এতটাই আকৃষ্ট করল যে, ছোট ছেলের নাম রাখলেন রাসেল। ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লেখেন, ‘রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইত না। যেখানে যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব আব্বা ওকে নিয়ে যেতেন। মা ওর জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ আব্বা প্রিন্স স্যুট যেদিন পরতেন সেদিন রাসেলও পরত। কাপড়-চোপড়ের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই তার নিজের পছন্দ ছিল। তবে একবার একটা জিনিস পছন্দ হলে তা আর ছাড়তে চাইত না। ওর নিজের একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। নিজের পছন্দের ওপর খুব আস্তা ছিল। খুব স্বাধীন মত নিয়ে চলতে চাইত। ছোট মানুষটার চরিত্রের দৃঢ়তা দেখে অবাক হতে হতো। বড় হলে সে যে বিশেষ একটা মানুষ হবে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।’
রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইত না। যেখানে যেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব আব্বা ওকে নিয়ে যেতেন। মা ওর জন্য প্রিন্স স্যুট বানিয়ে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা তার ছোট ভাই সম্পর্কে লেখেন, শেখ রাসেল আমাদের ভালোবাসা। তার একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে—‘আব্বার সঙ্গে আমার ও রাসেলের জাপান, মস্কো ও লন্ডন বেড়াবার সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় সফর বলেই রাসেল বিদেশিদের সাথে খুব সৌজন্যমূলক ব্যবহার করত। সে ছোট্ট হলেও বুঝতে পারত কোথায়, কীভাবে চলতে শিখতে হবে। ঢাকায় ফিরে আমি যখন মা ও সবার কাছে ওর এই সুন্দর ব্যবহারের গল্প করেছি তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। লন্ডনে বিখ্যাত মাদাম তুসো’র মিউজিয়ামে আমরা যখন বেড়াতে যাই রাসেলের বিস্ময় আর কাটে না। আমরা দুইজন আব্বার সাথে নাটোরের উত্তরা গণভবনেও গিয়েছি। রাসেল সেখানে মাছ ধরত, আমরা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকার গণভবনেও রাসেল মাছদের খাবার খাওয়াত। ফুফাতো ভাই আরিফ তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুইজন একই স্কুলে পড়ত এবং একসঙ্গে খেলত। টুঙ্গিপাড়ায় তাদের একটা খুদে বাহিনী ছিল, যাদের সঙ্গে খালের পানিতে সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলায় মেতে থাকত তারা।’
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতায় লাল-সবুজের পতাকাসহ যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে বীর বাঙালির ইতিহাস সেখানেই রাসেল। রাসেল আজ শোকগাঁথার এক অনন্য চরিত্র। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়াকে উদ্ধৃত করে লেখেন, ‘রাসেল ছিল বঙ্গবন্ধুর কলিজার টুকরা। তিনি রাসেলকে এ দেশের সমস্ত শিশুর মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি শিশুই তার পিতা-মাতার কাছে বড় আদরের। এখানে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। আমাদের নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটাকে ভালো করে গড়তে হলে এই শিশুদের সঠিকভাবে গড়তে হবে। ওদের তাজা রক্তে দেশপ্রেম ঢুকাতে হবে। ওদের ভালোমতো গড়তে পারলেই আমি সার্থক।’
শেখ রাসেলের কথা বারবার উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে। রাসেলের জন্য তার আর্তনাদ শিশুর প্রতি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শেখ রাসেলকেও প্রাণ দিতে হয়েছে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে। কিন্তু রাসলেরেও ইচ্ছে ছিল শৈশবের দুরন্তপনা উড়ে বেড়াতে, ঘুরে বেড়াতে। তারও স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার। কিন্তু সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। ঝরে গেল বাগানের নিষ্পাপ কুঁড়ি। কেমন করে আমরা ভুলি শেখ রাসেলকে? এই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকাসহ যেখানে-যেখানে ছড়িয়ে আছে বীর বাঙালির ইতিহাস, সেখানেই শেখ রাসেল। শেখ রাসেল আমাদের কাছে আজ শোকগাঁথার এক কবিতার ভুবন।
আনজীর লিটন ।। ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক
[email protected]