কঠোর নিষেধাজ্ঞায় বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের দাম। রমজান, ঈদ, পূজা-পার্বণ বা যেকোনো ইস্যুতে সবার আগে যা বাড়ে ভোগ্যপণ্যের দাম। এর একটি বড় কারণ থাকে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) স্লিপ নিয়ে বাণিজ্য। রমজানের আগে সারাদেশে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর আবির্ভাব হয়, যারা মিল থেকে ডেলিভারি অর্ডার নিয়ে পণ্য সংগ্রহ করে না। অন্য ব্যবসায়ীর কাছে বাড়তি দামে পুনরায় স্লিপ বিক্রি করে দেন। এভাবে হাত বদলে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। অথচ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ তে ডিও প্রথা বাতিল করে এসও (সাপ্লাই অর্ডার) চালু করা হয়। কিন্তু যেখানে ১৫ দিনের মধ্যে পণ্যের ডেলিভারি নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এখনো সেই স্লিপ বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। দাম বাড়লেই ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজার, চাহিদা ও জোগানের দোহাই দেন। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে, সে পণ্যটি দেশে আমদানি না হলেও দাম বেড়ে যায়। আর দাম কমলে বেশি দামে কেনা বলেন। আর কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই সরবরাহ লাইনে কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে দাম উস্কে দেন। কৃষিপণ্যের বাজারে থাকে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য। এরাই বাজারকে অস্থির করে। এদের কারণে কৃষক ও ক্রেতা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃতে সরকারের নিত্য প্রয়োজনীয় সংক্রান্ত দর নির্ধারণ কমিটি কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেন। কৃষি বিপণন অধিদফতরও কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দর নির্ধারণ কমিটি চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে সয়াবিন ও পাম তেলের দর ঠিক করেন। এর আগে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চালের দর ও ২০ অক্টোবর আলুর দর নির্ধারণ করেছিল কৃষি বিপণন অধিদফতর। তবে নির্ধারিত দরে আলু, সয়াবিন তেল, চাল কোনোটাই দেশের কোথাও ক্রেতারা বাজারে পাননি। ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সংগঠনের মাঝে ব্যবধান বাড়ায় এবং সরকারের ওপর ব্যবসায়ীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা অপরাধে জড়ালেও শাস্তির দৃষ্টান্ত তেমন নেই। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা সেজে ব্যবসায়ীদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।

বাজার ও ভোক্তা খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্ধারিত দাম কার্যকরে সরকারের নিবিড় নজরদারি ও তদারকির অভাবে কখনোই বাজার দর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব, জনবল স্বল্পতা এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের হীন প্রচেষ্টা অনেকাংশে দায়ী। এছাড়াও নীতিনির্ধারকদের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের অবদানও কম নয়। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি সংস্থার বাজার মনিটরিং টিম কাজ করলেও তাতে সুফল আসে না। কারণ সকল মনিটরিং টিমগুলো বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করে বাজারে যায়। আবার বাজারে প্রবেশের আগে বাজার সমিতি ও চেম্বারগুলোকে অবহিত করে যায়। বাজার সমিতি ব্যবসায়ীদের আগে থেকেই সতর্ক করে দেন।

ফলে মনিটরিং টিম বাজারে তেমন কোনো ত্রুটি পায় না। আবার স্বল্প সময়ে বাজারে অবস্থান করলে, অনিয়ম বের করা কঠিন। সেকারণে এসব টিম বাজার মনিটরিং করে ফিরে যাওয়ার পরই বাজার আগের অবস্থানে চলে যায়।

বাজার মনিটরিং হওয়া উচিত পুরো বছর জুড়ে। বাজার মনিটরিং-এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথে বাজার সমিতি, চেম্বার প্রতিনিধি রাখা হলেও ভোক্তা হিসেবে ক্যাব প্রতিনিধি রাখা হয় না। ফলে বাজার মনিটরিং অনেকটাই একপেশে এবং ভোক্তাদের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যায়। এছাড়াও অনির্ধারিত সময়ে এবং বাজার সমিতিকে অবহিত না করে বাজার মনিটরিং করা হলে ভোক্তারা উপকৃত হতেন।

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ হলো নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু তারা তাদের আসল কাজ বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রমজান, ঈদ ও কোরবানির সময় নিত্যপণ্যের মজুদ, দর, সরবরাহ ও আমদানি নিয়ে সভা করেন। বাণিজ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এসব সভায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন, পাইকারি বাজার সমিতি, খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিনিধি, আমদানিকারক, মিল মালিক, সরবরাহকারীসহ অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু ভোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর প্রতিনিধিকে সভায় সেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয় না।

বাজার মনিটরিং-এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথে বাজার সমিতি, চেম্বার প্রতিনিধি রাখা হলেও ভোক্তা হিসেবে ক্যাব প্রতিনিধি রাখা হয় না। ফলে বাজার মনিটরিং অনেকটাই একপেশে এবং ভোক্তাদের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যায়।

সুবিশাল এ সভায় ভোক্তাদের একজন প্রতিনিধির কণ্ঠস্বর কতটুক প্রভাব বিস্তার ও ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। গণমাধ্যমকর্মীরা থাকেন একেবারেই উপেক্ষিত। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত জানানো হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তড়িঘড়ি শেষ করার দৃষ্টান্তও আছে। অনেক সময় মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দেয়।

সভাগুলোয় বাণিজ্যমন্ত্রী সবসময় নির্ধারিত মূল্য অবিলম্বে কার্যকর হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিন্তু বাজারে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। আবার দর বেঁধে না দিলে পণ্যের দাম আরও বাড়তো। নীতিনির্ধারকদের এ ধরনের মন্তব্যের কারণেও বাজার হুট করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

নিত্যপণ্যের অস্থিরতা রোধে সংকটকালীন সময়ে সরকারের জরুরি পরিকল্পনা থাকা উচিত। সংকটকালীন সময়ে খাদ্য বিভাগের আওতায় ওএমএস, টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বড় পরিসরে বিক্রি করা প্রয়োজন। বাজার তদারকিতে জেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চেম্বার, ক্যাব প্রতিনিধি, গণমাধ্যমসহ সরকারের অন্যান্য প্রশাসনিক অঙ্গগুলোকে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এছাড়াও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত খাদ্য-পণ্য কি পরিমাণ ও কারা আমদানি করছেন তাদের বিতরণ ব্যবস্থাও মনিটরিং করতে হবে। ভোক্তাদের শিক্ষাও সচেতনতায় আরও বেশি জোর দেওয়া দরকার। ভোক্তারা সচেতন হলেই ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম সংকট ও কূটকৌশল বুঝতে সক্ষম হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)