ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে। সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে অনিশ্চিত গন্তব্যে চলে যায় দেশ। অস্থির সময়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছিল।

নির্বাচিত সরকার হত্যা করে গণতন্ত্রের বদলে দেশের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তানের আদলে স্বৈরতন্ত্র। ১৫ আগস্ট কালরাতের পর থেকেই রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছিল। সেই অস্থিরতার পরিণতি ৭ নভেম্বর।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্ত্র ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার যে মধ্যযুগীয় স্বৈরাচারী নীতি, তার সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। দিনটি বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের আগে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছিল এবং নভেম্বরের প্রথমদিকে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। এই সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটে। সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীর মধ্যে নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলা কোনো কিছুর বালাই ছিল না। কিন্তু জাসদ এই সময়ে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং এই সময়ে জাসদের গণবাহিনী এবং সৈনিক সংস্থা তাদের সমর্থিত সৈনিকদের একত্রিত করে।

এই সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বেই তারা জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে নেয় এবং সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ৭ নভেম্বর প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন ২ জন সেক্টর কমান্ডার ও ১ জন সাব সেক্টর কমান্ডার। আর এই ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে স্বাধীন দেশে প্রথম ফাঁসি দেওয়া হয় আরেকজন সেক্টর কমান্ডারকে।

এছাড়া সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কোনো সেক্টর কমান্ডারকে সরাসরি কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হতে হয়নি। আর তাই হত্যার নৃশংস ভয়াবহতা ৭ নভেম্বর ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। যার সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে এইদিনে শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীর একটি অংশে ক্রোধ দানা বাঁধতে থাকে। এই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ।

নভেম্বরের শুরুতে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। ওই সময় বন্দি করা হয় তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। এরপর সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নেন খালেদ মোশাররফ।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সেনাবাহিনীর যে অংশটি জড়িত ছিল তারা বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এক পর্যায়ে জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এর চারদিন পরই কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে হয়ে যায় পাল্টা অভ্যুত্থান।

এই দিনে তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে প্রথমে হত্যা করা হয় খ্যাতনামা ৩ মুক্তিযোদ্ধাকে। হত্যার শিকার হলেন—খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, কে এন হুদা বীরউত্তম এবং এ টি এম হায়দার বীরবিক্রম। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুইজন কোম্পানি কমান্ডার আসাদ এবং জলিল।

সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস তার গ্রন্থে লিখেছেন ‘এছাড়াও এদিন উচ্ছৃংখল জওয়ানরা একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এই সময় হত্যা করা হয়।’

‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে গবেষক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের খবর পেয়েও থেকে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। কিন্তু যখন উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহী সেনারা শ্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তখন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। এতে তার পা ভেঙে যায় এবং পরে ধরা পড়েন। তার জায়গা হয় সামরিক হাসপাতালে। তিনি বেঁচে যান।

এর আগে ৬ নভেম্বর ভোরে গৃহবন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় যার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল সেই ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিল এই দলের নেতৃত্বে। তারা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসে কর্নেল রশিদের দুই নম্বর অ্যার্টিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে।

গোলাম মুরশিদ আরও বলেন, ‘মুক্তি পেয়েই জিয়াউর রহমান সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের সঙ্গে কথা না বলেই বেতারে ভাষণ দিতে চলে যান। ’৭১-এর ২৭ মার্চের মতোই সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর  অনুরোধে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ তিনি প্রথমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পরে শুধরে নিয়েছিলেন। এবারও তিনি নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন।’

পরবর্তীতে একে একে গণভোট, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও, তার আমলে ২০টির বেশি অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়। এক হিসাবে প্রায় প্রতি তিন মাসে একটি করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল জিয়ার শাসন আমলে।

এই ব্যাপারে গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘একবার ফারুক-রশিদ প্রমুখের শৃঙ্খলা ভঙ্গকে ক্ষমা করার পর, জিয়া সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে খুবই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একটার পর একটা অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীতে হতেই থাকে। প্রতিটি অভ্যুত্থানের পর বহু সেনা সদস্যকে তিনি ফাঁসিতে ঝোলান। অনেককে বিনা বিচারেও পাইকারিভাবে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে ’৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমান বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর শত শত লোককে বিনা বিচারে অথবা সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, ঐ সময়ে বিমান বাহিনীতে মাত্র ১১ জন কর্মকর্তা অবশিষ্ট থাকেন। তাদের মধ্যে বিমান চালাতে পারতেন মাত্র তিনজন।’

মার্কাস ফ্র্যান্ডা’র  মতে, এই অভ্যুত্থানের কারণে আড়াই হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়। সর্বশেষ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর, মেজর জেনারেল মঞ্জুরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল এবং গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের চরিত্রই বদলে দেওয়া হয়। এই অভ্যুত্থানের নামে বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় দীর্ঘ অবৈধ সেনা শাসনের ভিত রচিত হয়। জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়।

নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, অবৈধ উপায়ে একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

দেশের প্রচলিত গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হ্যাঁ-না ভোট করা, সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তুলে দেওয়া, রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন করেন তিনি।

এছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করা হয় তার আমলে। তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সেনাকর্মকর্তা হত্যা ও হাজার হাজার সেনা সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করেন সামরিক শাসক জিয়া।

এদিকে জিয়া সরকার খুনিদের নিরাপত্তা দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা, জেলহত্যা বিচারের তদন্ত স্থগিত করা, বিনা কারণে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে ঢুকিয়ে দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান ও রাজনীতি করার সুযোগ দেয়।

শাহ আজিজের মতো যুদ্ধাপরাধীকে প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াসহ এমন সব অপকর্ম করেছেন যাতে বাংলাদেশ কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। ওই সময়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও আদর্শের পরিপন্থী।

একজন ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসক অবৈধ রাষ্ট্রপতি জিয়া নিজের ক্ষমতার স্বার্থের জন্য আইনের তোয়াক্কা না করে একেকটি অবৈধ সামরিক ফরমান জারি করতেন। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ নির্বাচন কিংবা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিজেকে একক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করে ‘হ্যাঁ কিংবা না’ ভোটের তামাশার নির্বাচন করেন। আবার ১৯৭৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি দলটি প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি ছিলেন সেনাপ্রধান। নির্বাচন কিংবা দল গঠন সবই ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও আইনের বরখেলাপ। যা রাষ্টদ্রোহিতারও শামিল।

৭ নভেম্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান ও উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। আর পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এই দিন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন। আর এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে উত্থান ঘটেছিল পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি।

জাতিকে যার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল দীর্ঘ ২১ বছর। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ পেয়েছিল আলোর দিশা। পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

খায়রুল আলম ।। যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)