ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলে প্রতিবারই জাতীয় নির্বাচন এলে কিছু নেতা এবং দল খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব নেতার হয়তো এক সময় খুব বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল। কিন্তু পরে নাম সর্বস্ব কোনো দলের নেতা কিংবা প্রধান নেতা হয়ে আছেন।

নির্বাচন এলেই এদের কদর বাড়ে। অর্থাৎ নির্বাচনের মাস কয়েক আগে থেকে এরা পাদপ্রদীপের কেন্দ্রে চলে আসে। গরম গরম কথা বলে। বড় বড় দলের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সভা বৈঠক করে। বড় নেতারাও তাদের একটু সমীহ করে চলে। ক্ষেত্র বিশেষে তোষামোদ করে।

গণমাধ্যমগুলোও তাদের নিয়ে বেশ মাতামাতি করে। আবার নির্বাচন শেষ হলে তারা চলে যায় আড়ালে। কেউ আর তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। গেল প্রায় সব’কটি জাতীয় নির্বাচনের আগে মোটামুটি একই চিত্র। তবে বিভিন্ন সময় বড় দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে থাকা ব্যক্তি সর্বস্ব দলগুলো আলাদা। এরা নির্বাচনের সময় কিংবা আগে পরে এতটা নজর কাড়ে না, যতটা শুরুতেই বর্ণনা দেওয়া দল কিংবা নেতারা কাড়ে।

নির্বাচনের সময় দেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব বাড়ে আরও এক ধরনের রাজনৈতিক দলের, চলতি ভাষায় আমরা যাদের ইসলামিক ঘরানার রাজনৈতিক দল বলে থাকি। দেখা যায়, নির্বাচনের সময় এদের নিয়ে টানাটানি শুরু করে বড় সব রাজনৈতিক দল। হতে পারে সরকারি দল। হতে পারে বিরোধী দল কিংবা অধুনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিভাষায় যুক্ত হওয়া রাজপথের বিরোধী দল।

সবাই এইসব দলের লেজে ঘি মাখতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু কেন তাদের নিয়ে এই টানাটানি, তোষামোদি? কেন তাদের সঙ্গে এত দর কষাকষি? ভোটের মাঠে এরা কতটা প্রভাব রাখে?

১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত চোখ রাখলে দেখা যায় ইসলামিক দলগুলো কখনোই উল্লেখযোগ্য আসনে জিততে পারেনি। তাতে এদের কদর কমে না। বরং ধীরে ধীরে বাড়ছে।

হেফাজতে ইসলামের কথা একটু বলা যেতে পারে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখায় গণমাধ্যমের ক্যামেরায়।

গণমাধ্যমগুলোও তাদের নিয়ে বেশ মাতামাতি করে। আবার নির্বাচন শেষ হলে তারা চলে যায় আড়ালে। কেউ আর তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না।

একাত্তরের রাজাকারের এমন ধৃষ্টতায় ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে শাহবাগ চত্বরে প্রতিবাদে জড়ো হয় কিছু প্রগতিশীল মানুষ। ক্রমে তা মহিরুহের আকার নেয়। শাহবাগ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। দেশের সীমা ছাড়িয়ে যেখানেই বাঙালি ও বাংলাদেশিদের বাস—সবাই একাত্ম হয় এই আন্দোলনে।

২০১৩ সালে এপ্রিলের প্রথমদিকে সরকারের শিক্ষা ও নারী নীতির প্রতিবাদ করে ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতের ১৩ দফার সবগুলোই প্রগতিশীল চিন্তার বিরোধী। আদতে তারা চেয়েছিল একটি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

হেফাজতের আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি হয় ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। তিন ঘণ্টার সমাবেশের অনুমতি পেয়ে তারা অবস্থান কর্মসূচির চেষ্টা করে এবং রাজধানীজুড়ে যে বীভৎস তাণ্ডব চালায় সেই কথা নিশ্চয় মানুষ ভুলে যায়নি।

এরপর হেফাজত কর্মীদের সেইখান থেকে সরানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থার চেষ্টাকে কীভাবে দেশ বিদেশে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা হয়েছে, কীভাবে নানা মহল থেকে পরিকল্পিত গুজব ছড়ানো হয়েছে তাও এখনো স্পষ্ট মনে আছে সবার। কিন্তু সেই ২০১৩ সালের পর খুব বেশি সময় কাটেনি। হেফাজত এখন অনেকটাই আওয়ামী লীগের কোলঘেঁষা।

দেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখে হেফাজতের দাবির মুখে পরিবর্তন আসে পাঠ্যবইয়ে। হেফাজত নেতারা প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বৈঠক করে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। অবশ্য একথাও সত্য হেফাজতের সঙ্গে এক ধরনের সখ্য হলেও কিছু নীতির এবং আইনের ক্ষেত্রে আপস করেনি সরকার। কিন্তু কথা হলো ২০১৩ সালে হেফাজত মতিঝিলে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত।

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানিয়েছে হেফাজতের পাশে থাকার। মূলত হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে ভর করে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছিল বিএনপি। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি তো হয়েছেই, উল্টো রাজনীতির অঙ্ক মেলাতে হেফাজত এখন আওয়ামী ঘেঁষা। যদিও হেফাজত এখনো মাঝে মাঝে আওয়ামী বিরোধী ফণা তোলে, তা অবশ্য দেশের মানুষ খুব একটা আমলে নেয় না।

যদি বিএনপি প্রসঙ্গে আসি, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের নামে তারাই স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করে। শুধু তাই নয় বিএনপির ছত্রছায়ার অন্ধকারের আড়াল থেকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে চলে আসে জামায়াতে ইসলাম।

১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত চোখ রাখলে দেখা যায় ইসলামিক দলগুলো কখনোই উল্লেখযোগ্য আসনে জিততে পারেনি।

রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে দেশে ফিরতে দেওয়া; অসুস্থ মা’কে দেখার কথা বলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে এসে বিএনপির ছায়া-মায়ায়, প্রশ্রয়ে-আশ্রয়ে এইদেশের রাজনীতিতে জেঁকে বসা; এরপরের গল্প তো সবার জানা!

বিএনপির সঙ্গে হাতে হাত রেখে জামায়াতের এগিয়ে চলা, বিএনপি জামায়াতের প্রায় দুই দশকের পুরোনো ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত হয়েছে কিছুদিন আগে। কিন্তু বিএনপির জামায়াত প্রিয়তা কাটেনি একটুও।

এছাড়া অন্য যেসব ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক চিন্তার রাজনৈতিক দল আছে তারাও প্রায় সবাই কোনো না কোনো বড় দলের সঙ্গে যুক্ত। অথচ মজার ব্যাপার হলো—আগ্রাসনবাদী ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনের ওপর জুলুম নিপীড়ন করে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে, এইসব দলের বেশিরভাগের মুখেই কিন্তু কুলুপ আঁটা। হ্যাঁ, দুয়েকটি ইসলামপন্থি দল প্রতিবাদ করেছে বটে। কিন্তু তাও মিনমিনে গলায়।

এমনটা কেন? কারণ মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশকে এরা রাজনীতির গুরু মানে, তারা যেহেতু পশ্চিমের বন্ধুদের না খ্যাপানো পন্থায় ফিলিস্তিন ইস্যুতে ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি নিয়েছে, তখন আমাদের ইসলাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোও হাঁটছে সেই পথে। ঘটনা নিশ্চয় পরিষ্কার হয়েছে এতক্ষণে?

বলছিলাম এসব দলের ভোটের মাঠে কোনো প্রভাব না থাকলেও বড় দলগুলো কেন এদের নিয়ে এত টানাটানি করে? আসল কারণ যেটা মনে হয় আমার কাছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো এক ধরনের অস্বস্তিতে ভোগে, অমুক দল কি আমার বিরোধী জোটে চলে গেল? তাদের জোটে দলের সংখ্যা কি আমাদের চেয়ে বেশি হয়ে গেল?

সেই ভাবনা থেকেই মনে হয়, এক ধরনের অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে—হয় বাবা তুমি আমার সঙ্গে থাকো, না হয় অন্য কারও কাছে যেও না। আর এই হিসাবটা ধর্মভিত্তিক দলগুলোও নিশ্চয় বোঝে। ফলে নির্বাচন সামনে এলেই তারাও হাত পেতে বসে থাকে—দেখি কোত্থেকে কী পাওয়া যায়?

আসল কথা হলো এসব দলের ভোটব্যাংক খুব একটা না থাকলেও ভোটের অঙ্ক মেলাতে তাদের কাছে রেখে বড় দলগুলো এক ধরনের শান্তি পায়।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী