ছবি : সংগৃহীত

লেখার এবং প্রকাশের মধ্যে যে অল্প সময়ের ব্যবধান, তার মধ্যেই বদলে যেতে পারে অনেক হিসাব নিকাশ। কারণ দলটির নাম জাতীয় পার্টি। যাদের বলা চলে প্রেডিক্টেবলি আনপ্রেডিক্টেবল। বাংলা করলে দাঁড়ায় নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চিত! অর্থাৎ জাতীয় পার্টির নেতাদের যে কোনো স্থিরতা নেই, তা এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।

নেতারা সকালে বলেন এক কথা। দুপুরে বলেন এক কথা। আবার সন্ধ্যা কিংবা রাত হতেই বদলে যায় তাদের মত। শুধু একবার নয়। একাধিকবার এমনটা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন এলে বাড়ে জাতীয় পার্টির অস্থিরতা।

এবারের নির্বাচন ঘিরেও একই রকম খেলা চলছে জাতীয় পার্টিতে। যদিও জল অনেক ঘোলা করার পর ২৮৭ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। তবে এতে অনেকেই আস্থা রাখতে পারছেন না। এমনকি মনোনয়ন পাওয়া অনেক প্রার্থীও আছেন সংশয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা থাকবে তো? নাকি কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসবেন?

প্রথমে আসি এবারের নির্বাচন প্রসঙ্গে। মাসখানেক আগে পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান এবং সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলছিলেন, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় পার্টি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। আবার বিএনপির মতো তারা নির্বাচন কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান কি না—তাও স্পষ্ট করে বলেননি জাতীয় পার্টির কোনো নেতা।

পরে আবার তারা বলছিলেন, জোট মহাজোটে নয়, জাতীয় পার্টি এককভাবে তিনশ আসনে নির্বাচনে করবে। এই ঘোষণার পরেও নির্বাচনে আসার ব্যাপারে তারা স্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেয়নি। এমনকি জাতীয় পার্টি যেদিন থেকে তাদের বনানীর কার্যালয়ে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের ডেকে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করেন, সেইদিনও তারা বলেছিলেন, ফরম বিতরণ মানে নির্বাচনে যাওয়ার নিশ্চয়তা নয়।

নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ফরম বিতরণ করছেন তারা! আবার মনোনয়ন ফরম বিতরণের দিন জাতীয় পার্টি থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো এবং গণমাধ্যমগুলো ছবিও দেখালো, তাদের প্রথম মনোনয়ন ফরমটি কিনেছেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ।

...অনেকেই আস্থা রাখতে পারছেন না। এমনকি মনোনয়ন পাওয়া অনেক প্রার্থীও আছেন সংশয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা থাকবে তো? নাকি কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসবেন?

ঘণ্টাখানেক পরই রওশন এরশাদের পক্ষে গণমাধ্যমের কাছে বিবৃতি পাঠানো হয়—রওশন এরশাদ কোনো মনোনয়ন ফরম নেননি! জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা তা নিয়ে ছিলেন নিশ্চুপ। কিন্তু মনোনয়ন ঘোষণার দিন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বললেন, ময়মনসিংহ-৪ আসনটি তারা ফাঁকা রেখেছেন রওশন এরশাদের জন্য! নাটক আর কাকে বলে!

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা। ২০১৪ সালের সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়ন দিলো। কিন্তু যখন খবর হলো বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তখন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘোষণা দিলেন জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে যাচ্ছে না। দলের সব প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন তিনি।

এরপর অজানা অসুখে পড়ে ভর্তি হলেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। দিনের পর দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর সেইখান থেকে একই সঙ্গে সুস্থ হয়ে এবং এমপি হয়ে বের হলেন এরশাদ! একই সঙ্গে সরকারের অংশ হলেন জাতীয় পার্টির এমপিরা। আবার প্রধান বিরোধীদলও হলেন তারা। মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় মধ্যপ্রাচ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

আবার সংসদে দাঁড়িয়ে এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমার দলের সদস্যদের মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বলুন। তারা আমার কথা শুনছে না।

এরপরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটে থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়। আবার কিছু আসনে লাঙ্গল নিয়েও লড়ে তারা। এবার আর সরকারের অংশীদারিত্ব পায়নি। শুধু বিরোধী দলে থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। কিন্তু গৃহপালিত বিরোধীদলের তকমা অনেকটা স্থায়ীভাবে লেগে গেছে তাদের নামের সঙ্গে।

ওদিকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাজনীতির মাঠ গরম করার কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। তিনিও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার! কিন্তু নির্বাচনের মৌসুম আসার পর তিনি আর পর্দার সামনে নেই। সামনে নেই তাকে ঘিরে থাকা জাতীয় পার্টির একাংশের নেতারাও। আদতে এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে বিদিশা এবং রওশন—দুইজনকেই মোকাবিলা করতে হচ্ছে জিএম কাদেরকে।

এ তো গেল কয়েকটি নির্বাচন ঘিরে জাতীয় পার্টির নাটকের কথা। বিশ্লেষকরা বলেন, দল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এমন নাটকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। বিভিন্ন দল থেকে ভাগিয়ে আনা নেতা এবং কিছু সামরিক অসামরিক আমলা নিয়ে দলটির যাত্রা শুরু।

ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, এরশাদও সকাল বিকাল নেতা পাল্টাতেন। সকালের মহাসচিব বিকেলে বদলে না গেলেও মোটামুটি মিউজিক্যাল চেয়ারের মতোই ছিল পদটি।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের তিন জোটের রূপরেখায় কী ছিল? পরে কারা ক্ষমতায় গিয়ে সেই রূপরেখা মানেনি তা নিয়ে এখনো তর্ক হয় বিস্তর। হওয়া অস্বাভিক নয়....

কিছুদিন পরপরই পরিবর্তন আসতো অন্যান্য শীর্ষ পদেও। কিন্তু একটি কথা অস্বীকারের জো নেই, কিছুদিন আগে পর্যন্তও বৃহত্তর রংপুর এবং আশপাশের এলাকায় ভালোই জনপ্রিয়তা ছিল দলটির। কিন্তু শীর্ষ নেতাদের খামখেয়ালি আচরণ, অর্ন্তদ্বন্দ্বসহ নানা কারণে দলটির সেই জনপ্রিয়তাও এখন তলানিতে।

তবু্ও গেল কয়েকটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এত কথা হয় কেন? কিংবা তারা এখনো কেন রাজনীতির ফ্যাক্টর বলে বিবেচিত হচ্ছে? কারণ বিএনপির নির্বাচনে না আসা। কিংবা এসেও তেমন আলোড়ন তুলতে না পারা। কিন্তু বিএনপির অনুপস্থিতে জাতীয় পার্টিকে যতটা ফ্যাক্টর বলে বিবেচনা করা হয়, তারা কি আসলেই ততটা? নিশ্চয়ই না।

এক সময় এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল। ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের পর মাত্র একটি নির্বাচন, অর্থাৎ ১৯৯১’র নির্বাচনের পরই আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রায় ফ্যাক্টর হয়ে গেল ‘পতিত স্বৈরাচারের’ দলটি!

গণতন্ত্রের জন্য এত রক্ত, এত ত্যাগের ফল তাহলে কী দাঁড়াল? নূর হোসেন, দিপালী, দেলোয়ারকে এত অল্প সময়ে কীভাবে ভুলে গেল আমাদের গণতান্ত্রিক দলগুলো?

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের তিন জোটের রূপরেখায় কী ছিল? পরে কারা ক্ষমতায় গিয়ে সেই রূপরেখা মানেনি তা নিয়ে এখনো তর্ক হয় বিস্তর। হওয়া অস্বাভিক নয়। কিন্তু এরশাদই বোধহয় একমাত্র সামরিক স্বৈরশাসক, যিনি পতনের পরেও রাজনীতি করে গেছেন দাপটের সঙ্গে। সামরিক শাসক হয়েও আমাদের গণতান্ত্রিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন সময়।

এবারের মনোনয়নের পর, জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদপন্থী নেতা, গোলাম মোহাম্মদসহ গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন পর্যন্ত চারবার ভেঙেছে। পঞ্চমবার ভাঙনের মুখে।’

পঞ্চম ভাঙন এখনো হয়নি, হতে কতক্ষণ। তবে মনেপ্রাণে আশা করি দলটি আর না ভাঙুক। কারণ ভাঙন থেকে কখনোই ভালো কিছুর সৃষ্টি হয় না। ভাঙন পতন ডেকে আনে, অনাসৃষ্টি ডেকে আনে। দেশের মানুষ আর কোনো অনাসৃষ্টি দেখতে চায় না। মানুষ চায় সৃষ্টি সুখের উল্লাস। আসছে নির্বাচন হোক সৃজনের আনন্দের। ভোটের উল্লাসের।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী