ছবি : সংগৃহীত

২০৪১ সালের মধ্যে সরকার বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চায়। এজন্য দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে যা বর্তমানে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন আছে।

দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় আনুষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহজ প্রবেশ সুবিধা দিতে আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার সাধন এবং মোবাইল ও ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে বৃহত্তর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা প্রথম প্রকাশ করে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয় যা বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

বর্তমানে ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দরকার ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ক্যাশলেস অর্থনীতি গড়ে তোলা।

এখানে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে মোবাইল মানি, অনলাইন অ্যাকাউন্ট, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট, ইলেকট্রনিক ক্রেডিট, ইলেকট্রনিক ইনস্যুরেন্স—ইত্যাদির সংমিশ্রণের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়াকে বোঝায়। ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দেশের সব মানুষকে ব্যাংকিং সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মতোই বাংলাদেশে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা যথেষ্টই কঠিন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে ব্যাংকে গিয়ে বড়সড় ফরম পূরণ করতে হয়; নানা ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয় এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারী একজন পরিচিত ব্যক্তির সুপারিশ নিতে হয়।

ব্যাংকিং ক্ষেত্রে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দরকার ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ক্যাশলেস অর্থনীতি গড়ে তোলা। এখানে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে মোবাইল মানি, অনলাইন অ্যাকাউন্ট, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট, ইলেকট্রনিক ক্রেডিট, ইলেকট্রনিক ইনস্যুরেন্স—ইত্যাদির সংমিশ্রণের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়াকে বোঝায়।

নানাবিধ জটিলতার কারণের প্রচলিত তপসিলি ব্যাংকে একাউন্ট বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাস্তবিক অর্থেই কঠিন ও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। ফলে সাধারণ নিম্নআয়ের মানুষদের ব্যাংকিং সেবা প্রদানে সরকার ও তপসিলি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উদ্ভাবনী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেমন—দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবাভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যার সংখ্যা প্রায় ৯৬ লাখ। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬১ লাখ। আবার, হতদরিদ্রদের জন্য অ্যাকাউন্ট ছিল প্রায় ২৬ লাখের কাছাকাছি এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিশেষ একাউন্টের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩৯ লাখ।

এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে আসার জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যার সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭ লাখ।

ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল হিসেবে প্রথমে মোবাইল ফোনের সংযোগ ও পরবর্তীতে ইন্টারনেট সংযোগ সুলভ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে এখন একটি মোবাইল ফোনের সংযোগ আছে এবং বেশিরভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এর ফলে বিভিন্ন বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, যেমন—মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং অন্যান্য ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে অনুমতি প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশে এমএফএস-এর উস্ফলন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে খুব সহজে বোঝা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০১৮ মাসে এমএফএস অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ কোটি ৭৭ লাখ যা কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর রাতারাতি বাড়তে থাকে।

দেখা যায়, নভেম্বর ২০২০ মাসে এমএফএস অ্যাকাউন্ট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ কোটি ৩ লাখে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মাসে এই সংখ্যা হয় প্রায় ২১ কোটি ৫০ লাখ।

এমএফএস অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ধারণার চেয়েও দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে এবং প্রান্তিক মানুষেরা ব্যাংক একাউন্টের মালিক না হয়েও এমএফএস ব্যবহার করতে থাকে। এর ফলে সরকার অনেক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, যেমন—কোভিড-১৯ মহামারির সময় এমএফএস-এর মাধ্যমে সরাসরি সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিশেষ ভাতা দেয়। তবে এমএফএস মূলত পেমেন্ট সার্ভিসের জন্য ব্যবহৃত হয়। সঞ্চয়, ঋণ বা বিনিয়োগের মতো ব্যাংকিং সেবাগুলো মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব না।

দেশে ইন্টারনেটের প্রসারে তপসিলি ব্যাংকগুলো ইন্টারনেট ব্যাংকিং-এ মনোযোগী হয়েছে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টধারীরা ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করছেন এবং তাদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৯ লাখ যা দুই বছর পরে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭৬ লাখে।

দেখা যাচ্ছে, দেশে এমএফএস যেভাবে প্রসার ঘটেছে, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর প্রসার সেইভাবে ঘটেনি। মোট ব্যাংক একউন্টধারীর একটি ক্ষুদ্র অংশই এখন পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সেবা নিচ্ছেন। আবার স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, দেশের প্রান্তিক মানুষ এমএফএস ব্যবহার করলেও তাদের বেশিরভাগ বিদ্যমান ব্যাংকিং সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আবার, বিশ্বব্যাংকের দ্য গ্লোবাল ফিনডেক্স ডেটাবেজ ২০২১ স্টাডি অনুযায়ী দেশে এখনো তিন কোটি মানুষ প্রচলিত ব্যাংকিং বা এমএফএস ব্যবহারের আওতায় নেই। ফলে দেশে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির এই পলিসি গ্যাপ পূরণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং’ একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রচলিত পদ্ধতিতে সরাসরি কাউন্টারে না গিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এর সহায়তায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করাকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং নামে আখ্যায়িত করেছে।

প্রচলিত পদ্ধতিতে সরাসরি কাউন্টারে না গিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এর সহায়তায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করাকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং নামে আখ্যায়িত করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন বিষয়ক গাইডলাইন অনুযায়ী ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনাবিহীন হবে, তার প্রধান কার্যালয় থাকলেও কোনো শাখা থাকবে না। কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা পাওয়া যাবে না এসব ব্যাংক থেকে। ব্যাংকের সেবা পাওয়া যাবে ডিজিটালি। তাই কোনো এটিএমও ডিজিটাল ব্যাংকের থাকবে না। ভার্চুয়াল কার্ড বা কিউআর কোড ব্যবহার করে গ্রাহকরা বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারবে। এসব ব্যাংক শুধু ছোট ঋণ দিতে পারবে।

এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গত অক্টোবর মাসে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে দুইটি প্রতিষ্ঠান নগদ ডিজিটাল ব্যাংক ও কড়ি ডিজিটাল ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

তবে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা পেতে হলে গ্রাহককে একটি স্মার্টফোন থাকতে হবে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে। তার জন্য সাধারণ মানুষের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাভাষায় অ্যাপ তৈরি করতে হবে যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সহজে বুঝতে পারে। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া পুরো সিস্টেমকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার একটি স্তম্ভ হলো স্মার্ট অর্থনীতি। দেশের সব নাগরিককে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে না আনলে কখনোই স্মার্ট অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১৩টি লক্ষ্যমাত্রা নাগরিকদের ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আনলে সহজে অর্জন করা সম্ভব। তাই ডিজিটাল ব্যাংক একটি বড় সম্ভাবনা হয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। এখন দেখতে হবে বাংলাদেশ এই সুযোগকে কতটুকু কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার পথে একটি বড় ধাপ অতিক্রম করে।  

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়