এরশাদ সাহেব যখন বাংলা একাডেমিকে হুকুম দিলেন বাংলা বর্ষপঞ্জিটাকে ভারতের বাংলা বর্ষপঞ্জি থেকে স্বতন্ত্র করে বানানোর জন্য, তখন সেই হুকুমের পেছনকার মনস্তত্ত্ব পাঠ করতে বিশেষ কোনো বড় বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু এসব আলাপ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং বেহুদা। যে জিনিসটা আপনার বা আমার মতো অপেক্ষাকৃত ‘সাধারণ’ লোকও বুঝতে পারছি সেটা দেশের জাতীয় বুদ্ধিজীবী, একাডেমির পরিচালকবৃন্দ, সাংসদ সকলেরই সহজবোধ্য ছিল। সমস্যা হলো, এখন একদল লোকের মনেই পড়বে না সেসব, আরেকদল লোক মনে পড়ার পরও আমার এই কথার মধ্যকার ফাঁকফোকর-প্রমাণাদি নিয়ে মোচড়ামুচড়ি শুরু করবেন। এরশাদ ওরকম করেছিলেন কারণ তিনি নিজেও বাংলা বর্ষপঞ্জিটাকে যথেষ্ট ‘হিন্দুয়ানি’ ভাবতে শুরু করেছিলেন; এবং তার ইসলামনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি জীবনে, রাষ্ট্রধর্ম বিলের গৌরবময় কারিগর হিসেবে, সেটাকে বলবৎ রাখতে পারছিলেন না।

বর্ষপঞ্জিটা আকবর যে উদ্দেশ্যেই বানিয়ে থাকুন না কেন, তার মধ্যে/উপরে হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পণ্ডিতরা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধির জিনিসগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আন্দাজ করা যায়, যদি আকবর ‘নিখিল ভারতীয়’ ক্যালেন্ডার হিসাবে হিজরি বর্ষপঞ্জিকেই ফরমান দিতেন, তাহলেও স্থানীয় হিন্দু-পণ্ডিতরা সেটাতেই নিজেদের জ্ঞানমোচন ঘটাতেন। ফিউশনের কাজই এটা। এরশাদ সাহেব যেটা কারিগরি করতে গেছেন, সেটা ইতোমধ্যেই একটা ফিউশন-প্রডাক্ট। তিনি আরও একদফা ফিউশন ঘটাতে চেয়েছেন যাতে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে আমাদের কিছু স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়।

সংমিশ্রণ কিংবা সম্মিলনের বদলে যে ফিউশন কথাটা ব্যবহার করলাম সেটা শব্দটার প্রতি, কিংবা এই ধারণাটির প্রতি আমার কোনো বৈরিতা থেকে নয়। বরং একেবারেই উল্টো। খাবার হোক বা সঙ্গীত, সাহিত্য কিংবা স্থাপত্য আমি বরং ফিউশনের আন্তরিক গুণগ্রাহী। নিউ ইয়র্ক থেকে যে পাই বানানো শিখে এলেন, তা নওগাঁতে বানাতে গিয়ে যদি এলাচ দানা বা দু’চারটা থানকুনি পাতাও দিয়ে দেন কেউ, তাতে আমার আসলে আপত্তির থেকে উত্তেজনাই বেশি হবে। তাছাড়া, সংস্কৃতি-সংযোগ বলে সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস শাস্ত্রসমূহে যে জয়গান গাওয়া হয় তা ধারণার দিক থেকে আসলে সঙ্গীত বাজারের ফিউশনই।

যতই কৃষিজ সংস্কৃতির বুনিয়াদ থেকে, লোকজ অভিব্যক্তি থেকে, কৃষিজ ভূমি আর তার কায়িক উৎপাদককে উৎসব থেকে ঠেলেঠুলে পানীয় আর প্ল্যাস্টিক বানানোর কারখানার মালিকদের মালামাল বিক্রির হাটে পরিণত করবেন, ততই জনপদের মানুষজনের সেসব উৎসবকে অনাপন-দূরের মনে হতে থাকবে।

কাস্টমাইজেশন, লোকালাইজেশন, ফিউশন ইত্যাদি ভাষামালা খোদ বিশ্বায়নের কালে আরও আরও অর্থ বহন করেছে; আরও ব্যাপৃত হয়েছে। কেন অর্থ বেশি বহন করে সেটা সম্পূর্ণ একটা স্বতন্ত্র আলাপ। আজকে না তুলতে চেয়ে বলি, বিশ্বায়নের একটা মানেই হলো স্থানসমূহের মোজাইক উপস্থাপন। তাই ‘স্থান’ বা ‘লোকাল’গুলোকে টেনে টেনে নানান জায়গায় না বসাতে পারলে বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক মিশন ব্যাহত হয়। কিন্তু, এখানে আলাপটা অন্যত্র।

ফিউশনের একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জের জায়গা হচ্ছে জবরদস্তি আর ক্ষমতার প্রসঙ্গ। কোন বিষয়গুলো সমাজের মানুষজন চলতে-ফিরতে আপন করে নিয়েছেন; আর কোন বিষয়গুলো জোরজুলুম করে তাদের অভ্যাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে; কিংবা কোন বিষয়গুলো তারা একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর অবলম্বন করে রাখতে পারেন নাই এইসব ইতিহাসের আরেকটা কালে ধামাচাপা পড়ে যায়। জুলুমকৃত উপাদানকে তখন হতে পারে সাদরে গৃহীত, উচ্ছেদকৃত উপাদানকে তখন মনে হতে পারে সপাটে বর্জিত।

পহেলা বৈশাখের প্রাক্কালে এগুলো বলা লাগল ক্রমাগত উৎসবটার শহরধর্মী হয়ে ওঠার কারণেই। এমনিতেই বাংলাদেশে বিদ্যমান সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন যে এই উৎসবটি, এই বর্ষপঞ্জিটি এখানকার ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষের আগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; কিংবা তাদের সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তুলছেন যারা, ধর্মের দোহাই দিয়ে তুলছেন। অথচ তারা নিজেরা যে গ্রামে-গঞ্জে কয়েক প্রজন্ম ধরে নতুন বছরটির উদ্দীপনা, উৎসব আর আচার-অনুষ্ঠান দেখে আসেননি তা নয়। কিন্তু এসব আওয়াজ যে তুলতে পারছেন তারা, তার রাজনৈতিক বুনিয়াদ আছে। এই আওয়াজের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্রের পলিসিগত, হঠকারী রাজনৈতিক তৎপরতার সম্পর্ক আছে। ঠিক সেই কারণেই, এরশাদের প্রসঙ্গটা দিয়ে শুরু করি। পাশাপাশি আপত্তি তুলতে পারার অন্যান্য অনুষঙ্গও রয়েছে। যেমন উৎসবটির নিরঙ্কুশ নগরধর্মী আর পুঁজির চক্কর খাওয়া হয়ে পড়া। যতই কৃষিজ সংস্কৃতির বুনিয়াদ থেকে, লোকজ অভিব্যক্তি থেকে, কৃষিজ ভূমি আর তার কায়িক উৎপাদককে উৎসব থেকে ঠেলেঠুলে পানীয় আর প্ল্যাস্টিক বানানোর কারখানার মালিকদের মালামাল বিক্রির হাটে পরিণত করবেন, ততই জনপদের মানুষজনের সেসব উৎসবকে অনাপন-দূরের মনে হতে থাকবে। এরকম পরিস্থিতিতে যে যার স্বার্থের স্বরগুলো হাজির করতে থাকেন।

নববর্ষ সেরকম একটা বৈরিতার উৎসবে পরিণত হয়ে গেছে—অজুহাতে উৎসব বিরোধী পক্ষ আছেন; উৎসবের উছিলায় তামাম পণ্য খাইয়ে দেওয়ার পক্ষ আছেন; নগরের সংস্কৃতির গর্বে তামাম বাংলাদেশকে দেখেন না এমন পক্ষ আছেন...

আমি নিজে বিশেষ উৎসবমুখর মানুষ নই, কোনো ধরনেরই। কিন্তু যারা উৎসবমুখর তাদের সেসব উৎসবের সাংঘর্ষিকতাগুলো নিয়ে না-ভেবে পারা যায় না। নববর্ষ সেরকম একটা বৈরিতার উৎসবে পরিণত হয়ে গেছে—অজুহাতে উৎসব বিরোধী পক্ষ আছেন; উৎসবের উছিলায় তামাম পণ্য খাইয়ে দেওয়ার পক্ষ আছেন; নগরের সংস্কৃতির গর্বে তামাম বাংলাদেশকে দেখেন না এমন পক্ষ আছেন; আর আছেন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় রাজনৈতিক ম্যান্ডেটের গুণ্ডামির জোরে যৌন আক্রমণ করে-বেড়ানো পক্ষ। সবাই জানেন এগুলো; উচ্চারণও করেন কেউ কেউ।

এখানে, পুরা বিষয়টাকে দেখার ক্ষেত্রে কয়েকটা প্রসঙ্গ মনে রাখার প্রস্তাব আমার। সহজ, তাও মনে করিয়ে দেওয়া: আপন-পরের ভেদবিচার, মানুষের নিজের পরিচয় উপস্থাপন করার নানাবিধ প্রণালী, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নানাবিধ ব্যক্তি আর গোষ্ঠীর সম্বন্ধের বোধ, পরস্পর বৈরিতাময় অর্থের সহাবস্থান, উৎস কিংবা আদিরূপ নিয়ে নানাবিধ সত্য বা মনগড়া কথার লড়াই ইত্যাদি। যে তালিকাটা বললাম এটা একটা দৈবাৎ তালিকা মাত্র। একটু বসে আমরা যে কেউ নিপুণ একটা তালিকা বানাতে পারব যেখানে সঙ্কটের প্রায় সবটাই লিপিবদ্ধ করা যাবে; আবার সেগুলো পরস্পর সম্পর্কিতও বটে। যেমন, আপন-পরের সীমানা নির্ধারণ করার সময়েই সেসব প্রথা বা আচারের প্রসঙ্গ চলে আসবেই যাকে এক পক্ষ ‘নিজের’ বলে ভাবছেন, কিংবা ভাবছেন না। আবার আপন-পরের এই সীমানা কিছুতেই ততটা সমস্যাজনক নয় যতক্ষণ সকলে তার ‘আপন’ চিহ্ন নিয়ে হাজির থাকতে পারছেন। সমস্যাটা ঘটে ‘জবরদস্তিতে’—উৎখাতের জবরদস্তি হোক, আর আত্তীকরণের জবরদস্তি।

ব্যক্তির জীবন-মৃত্যুর মতো উৎসব জৈবচক্র নয়। ব্যক্তি মরে যান, যাচ্ছেন লাগাতার, উৎসব অত সহজে মরে না। কিন্তু তাই বলে উৎসব (বা সংস্কৃতি) অমরও নয়। ইতিহাসে নানান বাঁকবদল ঘটেছে, ঠিক যেমন একজন সম্রাট আকবরের পাঞ্জাব-মহারাষ্ট্রের ফসল-মৌসুম কেন্দ্রিক বর্ষপঞ্জিটাকে বাংলা অঞ্চলের মানুষজনও আপন করে নিয়েছেন। সেজন্যই আরও প্রতীকের লড়াই, প্রথার লড়াই মরণপণ হওয়া বৃথা অপচয়। মানুষের প্রজ্ঞার অপচয়, ক্রোধের অপচয়, এমনকি বিধানের অপচয়। তাছাড়া পহেলা বৈশাখের উৎসবে সত্যি যদি কারো ক্ষুব্ধ হতে ইচ্ছা করে, তাহলে সেই মানুষগুলোরই কেবল নৈতিক আর রাজনৈতিক অধিকার আছে যার কৃষিজ জমিতে প্রাণান্ত শ্রম দিয়েও উৎপাদন মূল্যে কৃষিজ শস্য বিক্রি করতে হচ্ছে। যার নিজের শ্রমের অহেতু বছরব্যাপী পরিশ্রান্ত খরচের মুদ্রামান নেই। আর যার চৌহদ্দি থেকে তার হালখাতা উচ্ছেদ করে ফেলেছি আমরা। তার হাল আছে, খাতা নেই হিসাবের। সংক্ষোভ কেবল তাকেই মানায়!

মানস চৌধুরী ।। অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়