ছবি : সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর বিরুদ্ধে লেখা ও কথার মাধ্যমে যুক্তি দিয়ে যারাই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাদের কথা ও লেখায় সরকার কেবল ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছে।

সবকিছুতে ষড়যন্ত্র খোঁজা দুর্বলতার লক্ষণ। যুক্তি যেখানে অনুপস্থিত ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজাই তখন তাদের একমাত্র অস্ত্র। নতুন এই শিক্ষাক্রমের পক্ষে বলার মতো কিছু নেই।

উচিত ছিল নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভাগ উঠিয়ে বড়জোর ৪টা বিষয় বাধ্যতামূলক রেখে বাকি ৬টা বিষয় উন্মুক্ত করে দেওয়া, যাতে যে যার ইচ্ছেমতো বিষয় নির্বাচন করতে পারে।

বেছে নেওয়ার জন্য সাবজেক্টগুলো হতে পারতো—উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, হিসাব বিজ্ঞান, অর্থনীতি, কৃষিবিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য, তথ্য প্রযুক্তি ও কম্পিউটার সাইন্স ইত্যাদি।

মানে একটু স্বাধীনতা থেকে আরও বেশি স্বাধীনতা দেওয়া। অথচ মন্ত্রণালয় গেল উল্টো পথে। একটু স্বাধীনতার জায়গায় পুরো স্বাধীনতা হরণ করে ঘাড়ে ধরে সবাইকে ১০টা বিষয় পড়তে বাধ্য করার যেই ব্যবস্থা তার নাম নতুন কারিকুলাম।

আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং আমলা হলেই তারা মনে করে তাদের নতুন কিছু করে দেখাতে হবে। কিন্তু সেইটা শিক্ষা কমিশনের বড় বড় শিক্ষাবিদদের দ্বারা প্রণীত শিক্ষা রিপোর্ট অনুসরণ করবে কি না সেইদিকে নজর নেই।

এরা মন চাইল পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা চালু করল। বলল—বেশি বেশি পরীক্ষা দিলে পরীক্ষার ভয় চলে যাবে। সমালোচনা শুরু হওয়ার পরে ওই দুই পরীক্ষা বাদ দিয়ে দিলো। রাগে-ক্ষোভে নতুন শিক্ষাক্রমের কারিকুলাম থেকে পরীক্ষাই প্রায় তুলে দিয়েছে। এখন ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে নতুন আরেক সিস্টেম চালু করল।

...পরীক্ষার সিস্টেমটাকেই হঠাৎ তছনছ করে দিলো। নম্বর নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় তাই নম্বর উঠিয়ে গ্রেড সিস্টেম চালু হলো। অন্য ফর্মে আরও বেশি প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এখন গ্রেড উঠিয়ে সিম্বল দেওয়া হলো।

পরীক্ষার ভয় কাটানোর জন্য বেশি বেশি পরীক্ষা চালু করল। সমালোচনা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শাস্তি হিসেবে—‘পরীক্ষা থাকবে না’ বিষয়টা যেন এমন। কল্পনা করতে পারেন শিক্ষাক্রম নিয়ে তাদের কী ধরনের ছেলেমানুষি।

লেখাপড়ার হলো বই সম্পর্কিত। বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই আমাদের শিক্ষার্থীরা ডিভাইসমুখী হয়ে যাচ্ছে। এখন নতুন কারিকুলামে বই পড়াকে প্রায় উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। এই কারিকুলাম পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের ইন্টারনেট থেকে তথ্য খুঁজে নিতে হচ্ছে।

পরীক্ষার সিস্টেমটাকেই হঠাৎ তছনছ করে দিলো। নম্বর নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় তাই নম্বর উঠিয়ে গ্রেড সিস্টেম চালু হলো। অন্য ফর্মে আরও বেশি প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এখন গ্রেড উঠিয়ে সিম্বল দেওয়া হলো। তাহলে এখন সিম্বল নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে!

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়া, চীন কোথায় পরীক্ষা নেই? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই হলো পরীক্ষা। পরীক্ষা মানেই কিছুটা চাপ। আর চাপ মানেই এক ধরনের বল। কাজের সংজ্ঞানুসারে বল ছাড়া কাজ হয় না মানে সরণ হয় না। অর্থাৎ চাপ ছাড়া জ্ঞানের সরণও হয় না।

ছাত্রজীবন মানেই পরীক্ষা, এটা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরীক্ষার আগে ১ ঘণ্টায় আমরা যা শিখতে পারি পরীক্ষা ছাড়া ২৪ ঘণ্টা পড়েও তা শিখতে পারি না।

চাপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে হতে পারে, কারও কারও ক্ষেত্রে নিজের ভেতর থেকেও হতে পারে। সারা পৃথিবীতে পরীক্ষার চাপ আছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা বিদেশে আছে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, পরীক্ষার সংখ্যা কেমন।

ওখানে ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষা ইত্যাদি পুরো সেমিস্টার জুড়ে লেগে থেকে। তারপর লম্বা বিরতি। সেই সময় তারা আনন্দ করে। ছাত্রজীবন মানেই পরীক্ষা, এটা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরীক্ষার আগে ১ ঘণ্টায় আমরা যা শিখতে পারি পরীক্ষা ছাড়া ২৪ ঘণ্টা পড়েও তা শিখতে পারি না।

অবিলম্বে এই শিক্ষাক্রমের কারিকুলাম বাদ দেওয়া উচিত। পুরোনো কারিকুলামকে যুগোপযোগী করা উচিত। অথবা আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের মতো করা উচিত।

ইংরেজি মাধ্যম যারা করেছে তারা গবেষণা করে বিশ্ব সেরা শিক্ষাবিদদের দিয়ে কারিকুলাম তৈরি করেছে। ইংরেজি মাধ্যমের মতো বাংলা মাধ্যমের কারিকুলামও করলে দেশের এই দুই মাধ্যমের বৈষম্য কমে যাবে এবং শিক্ষার মান সত্যিকারভাবে বাড়বে। কিন্তু তার আগে ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন এবং শিক্ষকদের উন্নত জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।

নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ বিশ্বের সুখী দেশগুলোর মধ্যে সেরা পাঁচে। কারণ সেই দেশের শিক্ষকরা সুখী। সুখী শিক্ষকরাই পারে আমাদের ছেলেমেয়েদের স্বপ্নবান বানাতে।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়