উন্নয়ন নিঃসন্দেহে এক বহুমাত্রিক বিষয়। মূলত কৃষিপ্রধান বিকাশমান দেশের পক্ষে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করাই তার উন্নয়ন কৌশলের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুদূরপ্রসারী কয়েকটি কথা বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—‘...যে জাতি উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে তার একটা লক্ষণ এই যে, ...যথাসম্ভব তাদের সকলেই মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করবার অধিকার পাচ্ছে। এই জন্যই সেখানে মানুষ ভাবছে কি করলে সেখানকার প্রত্যেকেই ভদ্র বাসায় বাস করবে, ভদ্রোচিত শিক্ষা পাবে, ভালো খাবে, ভালো রবে, রোগের হাত থেকে বাঁচবে এবং যথেষ্ট অবকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে।’

একটি নতুন দেশ যখন যাত্রা শুরু করে, অর্থাৎ যখন তাকে উন্নয়ন অর্থনীতির ভাষায় ‘ইমার্জিং কান্ট্রি’ বলা যায়, সেই সময়টায় অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার মূল জায়গায় থাকে মানুষের খেয়ে-পরে বাঁচার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধানত কৃষির ওপর ভর করে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করার কৌশল নেওয়া হয়।

যত দ্রুত যত বেশি সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য সীমার ওপর নিয়ে আসা যায় সেইটিই তখন থাকে মূল নীতি-ভাবনায় ও পরিকল্পনায়। ক্রমেই এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে জাতীয় অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষাগুলোরও রূপান্তর ঘটতে থাকে। নিছক ‘খেয়ে-পরে বাঁচা’র পরিধি থেকে বেরিয়ে প্রকৃত অর্থেই নাগরিকদের জন্য মানসম্পন্ন জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করা তখন নীতি ভাবনা ও সংলাপের কেন্দ্রে চলে আসে। এই বিষয়টিই রবীন্দ্রনাথ তার স্বভাবসুলভ সরল ভাষায় আর অল্প কথায় বলে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের মতোই আরেক শ্রেষ্ঠতম বাঙালি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতাও দেশবাসীদের আত্মমর্যাদাশীল নাগরিক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তার আজীবনের স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’য় মানুষের জীবন কেমন হবে তা তিনি নিজেই বলেছেন—‘আমি কী চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক? আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।’ (১৯৭২ সালের ০৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে ভাষণ থেকে)।

রবীন্দ্রনাথের মতোই আরেক শ্রেষ্ঠতম বাঙালি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতাও দেশবাসীদের আত্মমর্যাদাশীল নাগরিক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।

নিজের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের অনন্য অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। তাই মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলেই তিনি আমাদের মাথাপিছু আয় ৯১ ডলার থেকে ২৬০ ডলারে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে শারীরিকভাবে হারানোর পর আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রগতির রথ থেমে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং উল্টো দিকে যাত্রা করে।

স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পরে এসে আজ এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘ইমার্জিং কান্ট্রি’ বা বিকাশমুখী একটি দেশ হিসেবে প্রাথমিক অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষাগুলো আমরা ভালোভাবেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে প্রান্তে সব মানুষের খেয়ে-পরে বাঁচার নিশ্চয়তাটুকু তৈরি করা গেছে।

বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হারানোর পরের সময়টায় আমরা কিছুটা গতিহীন হয়ে পড়লেও তার চিন্তা ও আদর্শ আমাদের শেষ পর্যন্ত সঠিক পথেই চালিত করেছে। বিশেষ করে ১৪-১৫ বছরে, বঙ্গবন্ধুকন্যা দ্বিতীয় দফায় দেশ পরিচালনার ভার কাঁধে নেওয়ার পর থেকে, আমাদের অর্থনীতি এক নাটকীয় উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে গেছে। এই সময়টায় মাথাপিছু আয় ৭০০ মার্কিন ডলারের কম থেকে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি করে প্রায় ২,৭০০ মার্কিন ডলার করা গেছে। এর প্রভাব পড়েছে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হার হ্রাসের ক্ষেত্রেও (বিবিএস-এর সর্বশেষ তথ্য বলছে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ১৮.৭ শতাংশ এবং ৫.৬ শতাংশ)।

বার্ষিক রপ্তানি টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলারের সীমা ছাড়িয়েছে। বছরে ২০ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে। অবশ্যই বিনিময় হারটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা গেলে তা আরও অনেকটাই বেশি হতে পারতো। অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ বহু চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির ধারাটি বলশালীই রয়েছে।

সর্বশেষ মাস্টারকার্ড ইকোনমিকস ইন্সটিটিউট (এমইআই)-এর প্রতিবেদনে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২০২৪-এ অস্থির ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৩ শতাংশ (সরকারি হিসাবে আরও বেশি)। এই প্রবৃদ্ধির হার ভারত ও চীনসহ সমতুল্য ৪৬টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

অর্থনীতির সূচকগুলোয় এমন ইতিবাচক পারফরমেন্সের সুফল সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছেই পৌঁছানো গেছে। দারিদ্র্য কমে আসা, জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করার সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু দ্রুত কমিয়ে আনার মতো মানব উন্নয়ন সূচকে আমাদের অর্জনগুলো প্রমাণ করে যে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে সাফল্য এসেছে তাতে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষের ন্যায্য হিস্যাও নিশ্চিত করা গেছে একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।

সব মিলিয়ে এটা মানতেই হবে যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রযাত্রার একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। আমরা আর নিম্ন আয়ের দেশ নেই। বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। অচিরেই আমরা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছি। কাজেই কেবল প্রান্তিক মানুষের টিকে থাকা নিশ্চিত করাকেই আর সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করার সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি।

প্রত্যেক নাগরিকের তার নিজস্ব শক্তি ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে নিজের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো পরিবেশ তৈরিতে নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ১৪-১৫ বছরে নাগরিকদের জন্য টেকসই উন্নয়নের যে সম্ভাবনা আমরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি তা বাস্তবে রূপ দিতে পারলে আগামী ১০-১৫ বছর পরে আমরা উন্নত দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবো। তা করা গেলেই বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে’ বলে দাবি করা যাবে। আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়িত হবে। তবে তা মোটেও মসৃণ নয়। নানা খানা-খন্দে ভরা।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই পথনকশা বাস্তবায়নের বিষয়ে আশাবাদী হতেই হবে। একই সঙ্গে সংবেদনশীল থাকতে হবে চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়েও। মনে রাখা চাই, এখনো দেশের তিন কোটির বেশি নাগরিক দারিদ্র্য সীমার নিচেই আছেন। আরও অনেকে যারা দারিদ্র্য সীমার একটু উপরে আছন—তারাও আছেন ঝুঁকির মুখে। এদের ভাগ্যোন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য তাই নতুন বাস্তবতার উপযোগী সামাজিক সুরক্ষার পরিকল্পনা দরকার হবে (আলাদা করে নজর দিতে হবে নগরাঞ্চলের অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত কিংবা গ্রামাঞ্চলে অ-কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর দিকে)।

তবে কেবল সামাজিক সুরক্ষার দিকে তাকিয়ে না থেকে বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের চাহিদাও পূরণ করতে হবে। শ্রমবাজারে বছরে নতুন মুখ ঢুকছে ২০ লাখ, আর আনুষ্ঠানিক খাতে আমরা কাজ সৃষ্টি করতে পারছি মাত্রা ২ লাখের জন্য। তরুণ জনগোষ্ঠীর কাজে লাগাতে তাই কর্মসংস্থান তৈরিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য একদিকে এমএসএমই খাতের বিকাশের পথে বাধাগুলো দূর করা চাই। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের উদ্যোগগুলোও আরও গতিশীল করতে হবে।

এখনো দেশের তিন কোটির বেশি নাগরিক দারিদ্র্য সীমার নিচেই আছেন। আরও অনেকে যারা দারিদ্র্য সীমার একটু উপরে আছন—তারাও আছেন ঝুঁকির মুখে।

নতুন দিনের শিল্প ও কৃষি খাতের উপযোগী জনবলের চাহিদা পূরণে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর সময়ও তো বয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপক উদ্যোগগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার জন্য বিদেশমুখীতার সুযোগও খুব বেশি নেই। তাই সরকারকেই নিজের আয় বাড়াতে হবে। তাই কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের কাছাকাছি থেকে দ্রুত বাড়িয়ে ১৫ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য সাহসের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কারে আমাদের উদ্যোগী হতেই হবে।

এই সবগুলো অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য বিশেষ সহায়ক হবে ডিজিটাইজেশন। আর্থিক সেবা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগগুলো ইতিমধ্যেই আমাদের ব্যাপক সুফল দিয়েছে।

আশার কথা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ বাস্তবায়নের পথে আমাদের এই অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে আমরা এখন প্রযুক্তি ও তারুণ্যনির্ভর ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’র দিকে এগোচ্ছি। এটিই সঠিক পথ। তবে সুশাসনের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ আমরা এখনো কার্যকরভাবে মোকাবিলা কর উঠতে পারিনি। সুশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা না করা গেলে অন্য যে ক্ষেত্রে যতো অগ্রগতিই হোক তা টেকসই করা যাবে না।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে যে, আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বের যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে একেবারে শুরুর দিকে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামাল দিয়েই আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার টেকসই চরিত্র নিশ্চিত করতে হবে।

আশার কথা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এই যাবৎ কালের সাফল্য ও অভিজ্ঞতা সর্বত্রই প্রশংসিত। সত্যি বলতে সকল ক্ষেত্রেই আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে করেই নাটকীয় সাফল্য নিশ্চিত করেছি এতকাল। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে তাই স্বপ্ন দেখি—আগামীতেও সকলে মিলে এতো দিনের অগ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবো। কেননা জাতির পিতার কথায় ভরসা রেখে আমরাও বলতে চাই যে আমাদের রয়েছে উর্বর মাটি এবং পরিশ্রমী মানুষ। তাই ভয় কীসের? নিশ্চয় আমরা পারবো। খেয়ে

ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর