ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং রাজনীতি আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকায় এই নিয়ন্ত্রণ আরও নিরঙ্কুশ হয়েছে। মাঠে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা অনেক রিলাক্স মুডে সময় অতিবাহিত করছিলেন।

বিএনপি নির্বাচনে আসছে না, এটা জানার পর আওয়ামী লীগ নেতারা আরও নির্ভার হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে নানান সমালোচনা আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাওয়া। সেইবার ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন।

আর ২০১৮ সালের নির্বাচনের সমস্যা ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন। বিএনপি বর্জন করায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অনেকটা একতরফা হতে যাচ্ছে। তারপরও এবার আওয়ামী লীগ দুই নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে মরিয়া। কেউ যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ডামি প্রার্থী রাখার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ।

আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করতে বিদ্রোহীদের জন্য মাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই মাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে কি না, আলোচনা আছে তা নিয়েও।   

বাংলাদেশে এখন সক্রিয় ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো আওয়ামী লীগ। শুধু বয়সে পুরোনো বলেই নয়, আদর্শ, গুরুত্ব, অবদান—সব বিবেচনায়ই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী রাজনৈতিক সংগঠন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশ, এমনকি বিশ্বেও প্রভাববিস্তারী সংগঠনের তালিকা করলে তাতে ঠাঁই পাবে আওয়ামী লীগ। আর এই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তৃণমূলে বিস্তৃত তাদের সাংগঠনিক কাঠামো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

৬ বছর উদ্বাস্তু জীবনযাপন শেষে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে, ধ্বংস করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগকেও। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পেরেছিলেন, সেইটা এই তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা সংগঠন এবং ত্যাগী নেতাদের কারণেই।

সংগঠন যত বড়, তাতে কোন্দল তত বেশি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় এই কোন্দল আরও বেড়েছে। ক্ষমতার লোভে আসা হাইব্রিডদের দাপটে কোণঠাসা হয়েছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এখন প্রতিটি আসনেই অন্তত ৫ জন করে ব্যক্তি আছেন, যারা এমপি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু দল তো শেষ পর্যন্ত একজনকেই মনোনয়ন দিতে পারে। তাই বাকিরা বঞ্চিত থাকে, কোন্দল করে।

আর আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল কোথাও কোথাও এতটাই প্রকট, প্রতিপক্ষ দলের চেয়ে নিজ দলের শত্রুতাই বেশি। অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের এমপি থাকলেও সেইখানে তার প্রতিপক্ষ গ্রুপের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোনো সুযোগ সুবিধাই পাননি। সেই তুলনায় বরং বিএনপির লোকজন অনেক সুবিধা পেয়েছে।

আওয়ামী লীগের অবস্থাটা হয়েছে রাজার দুধের পুকুরের মতো। রাজা দুধের পুকুর বানাতে চেয়েছিলেন। প্রজাদের বলেছিলেন সবাই যেন এক পাত্র দুধ নিয়ে আসে। কিন্তু সবাই ভাবলো, অন্যরা তো দুধ নেবে, আমি না হয় পানিই নেই। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই পানিই এনেছে। তাই পানির পুকুরই হয়েছে, দুধের পুকুর আর হয়নি।

সংগঠন যত বড়, তাতে কোন্দল তত বেশি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় এই কোন্দল আরও বেড়েছে। ক্ষমতার লোভে আসা হাইব্রিডদের দাপটে কোণঠাসা হয়েছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

সারা দেশে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা শেখ হাসিনা বললে জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেই তিনিই নিজ আসনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য জান দিয়ে খাটবেন। অনেকেই চান আওয়ামী লীগ ২৯৯ আসনে পাস করুক, তার নিজের আসন ছাড়া। কারণ আওয়ামী লীগ করলেও ১৫ বছর তাদের থাকতে হয়েছে বিরোধী দলের মতো।

আওয়ামী লীগের এই দলীয় কোন্দলের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে দলীয় কোন্দল প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রার্থী হতে ইচ্ছুক এমন অনেকের মধ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নেওয়া হবে। নির্বাচনে প্রার্থীর বিষয়ে আমরা শত ফুল ফুটতে দেওয়ার পক্ষে। শত ফুল ফুটতে দিন, যে ফুলটি সব থেকে সুন্দর সেইটি আমি বেছে নেব।’

এরপর আওয়ামী লীগের এক বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রসঙ্গটি তোলেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও কোন্দলের কারণে হেরে যাওয়া আজমতউল্লাহ খান। তিনি দলীয় প্রধানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি শত ফুল ফোটাতে চেয়েছেন। কিন্তু ফুল ফুটতে চাইলে বড় ফুলের গাছটাই কেটে দেওয়া হয়।’

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মতো আরও অনেক স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের এই কোন্দলের প্রভাব আমরা দেখেছি। অনেক জায়গাতেই নৌকা হেরেছে বিদ্রোহীদের কাছে। এতদিন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ নির্বাচন করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের লড়াইয়ের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কোন্দলের বিষয়টিও উন্মুক্ত হয়ে গেছে।

দুটি নির্বাচনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাস করে যাওয়া আওয়ামী লীগের এবার ঘুম টুটে গেছে, ঘাম ছুটে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য লড়াইয়ের সুযোগ উন্মুক্ত করলেও একেবারে ফ্রি-স্টাইল করেনি। নইলে হয়তো ৩০০ আসনেই জমজমাট লড়াই হতে পারতো। তবে ৩০০ আসন না হলেও অন্তত দেড়শ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের লড়তে হবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাথে।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও এবার একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাদের অধিকাংশই ‘ঈগল’ প্রতীক পেয়েছেন। ১৪০ জন প্রার্থী লড়ছেন ‘ঈগল’ প্রতীক নিয়ে। যেসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি আছেন, ‘ঈগল’-এর পর তাদের পছন্দ ছিল ট্রাক।

৯৬ আসনে ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীরা নৌকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তৈরি। এখন পর্যন্ত মাঠের যা অবস্থা, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগের অনেক হেভিওয়েট নেতাকেই এবার ধরাশায়ী হতে হবে। অনেক এলাকায় আওয়ামী দুর্গের পতন ঘটবে আওয়ামী লীগেরই হাতে।

অনেক এলাকায় বর্তমান এমপি লড়ছেন স্বতন্ত্র হিসেবে। অনেক আসনে লড়াইয়ে থাকা দুই প্রার্থীই একাদশ সংসদের সদস্য। যেমন কুমিল্লা-৬ আসনের বর্তমান সাংসদ বাহাউদ্দিন বাহারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন সংরক্ষিত আসনের সাংসদ আনজুম সুলতানা সীমা। মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংরক্ষিত আসনের সাংসদ তাহমিনা বেগম।

এবার শেখ হাসিনাই তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। এবার জিততে হলে ঘাম ঝড়াতে হবে, জনগণের কাছে যেতে হবে। জনবিচ্ছিন্নরা যদি এবার হেরে যান, তাতে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি নেই। যিনি জিতবেন, তিনিও তো আওয়ামী লীগেরই।

ফরিদপুর-৪ আসন তো এখন গোটা বাংলাদেশেরই আগ্রহের কেন্দ্রে। আগের দুটি নির্বাচনেই এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ চৌধুরী। এবারও আওয়ামী লীগের এই হেভিওয়েট নেতাকে হ্যাট্রিক পরাজয়ের চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নিক্সন চৌধুরী।

ময়মনসিংহ-৩ আসনে গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিলুফার আনজুম পপির সাথে লড়ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহা।

অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে ‘ঈগল’ প্রতীকের প্রার্থীরাই হয়তো দ্বিতীয় হবে। সেই ক্ষেত্রে দ্বাদশ সংসদে বিরোধী দল কারা হবে, তা নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। তবে কৌতূহলের পাশাপাশি শঙ্কাও আছে। এবারের নির্বাচনের যেটুকু উত্তাপ-উত্তেজনা তা এই ‘ঈগল’এর কারণেই।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অনেকে। সংঘর্ষ হয়েছে অনেক এলাকায়। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

তারচেয়ে বড় কথা হলো, আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ে কোন্দলের যে চিত্র প্রকাশ্যে আনা হলো, তা ভবিষ্যতে আরও প্রকট হয় কি না। এই বিভক্তি, বিদ্বেষ আওয়ামী লীগের মূল শক্তি তৃণমূলকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করে দেয় কি না, ভাবনার অবকাশ আছে তা নিয়েও।

তবে টানা তিন মেয়াদে সহজে জয় পেয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের এমপিদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তারা ভেবেছেন, যেভাবেই হোক শেখ হাসিনা তাদের জিতিয়ে আনবেন, জনগণের ভোট লাগবে না। নিজ নিজ এলাকায় তারা নিজেদের আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।

এবার শেখ হাসিনাই তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। এবার জিততে হলে ঘাম ঝড়াতে হবে, জনগণের কাছে যেতে হবে। জনবিচ্ছিন্নরা যদি এবার হেরে যান, তাতে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি নেই। যিনি জিতবেন, তিনিও তো আওয়ামী লীগেরই।

বিএনপির অনুপস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে কিছুটা উত্তাপ এনেছেন, এটা মন্দ নয়। তবে প্রাণঘাতী সংঘাত বন্ধে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে কঠোর হতে হবে। আর নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ