ছবি : সংগৃহীত

এক সময় বাংলাদেশের মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারলেই খুশি থাকতেন। সকাল বেলা পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে কাজে চলে যেতেন কৃষক। সেই অবস্থা পেছনে ফেলে এসেছি আমরা অনেক আগেই। এখন আমাদের শ্রমিকরাও মাংস খাওয়ার স্বাধীনতা চায়।

১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে। মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে, প্রত্যাশা বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল, ২০২৩ সালে এসে বৈশ্বিক বাস্তবতায় তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে।

প্রথমে কোভিড, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দারুণ চাপের মুখে আছে। যার অভিঘাত সবচেয়ে বেশি করে লেগেছে দেশের বাজারে। নিত্যপণ্যের দাম এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মানুষের জীবনমান যেখানে পৌঁছেছিল, এক ধাক্কায় সেইখান থেকে অনেকটাই নেমে এসেছে। জীবনমান উন্নয়নের কৃতিত্ব যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের, জীবনমান নেমে যাওয়ার দায়ও আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।

বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। আগের মেয়াদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিলেন। সিন্ডিকেটের কাছে নিজের অসহায়ত্ব স্বীকার করেছেন। ব্যবসায়ীরা কখনো ডিম, কখনো মুরগি, কখনো পেঁয়াজ, কখনো আলু নিয়ে খেলা করেছেন।

হুট করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়া যে স্বাভাবিক নয়, সেইটা সবাই বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু কারও হাতেই যেন কোনো সমাধান ছিল না। নতুন সরকারের সামনে তাই এক নম্বর চ্যালেঞ্জ তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সমস্যাটা যে আওয়ামী লীগও বুঝতে পেরেছিল, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেই তা পরিষ্কার।

আওয়ামী লীগের ১১টি অগ্রাধিকারের এক নম্বরে ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অঙ্গীকার। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া শেখ হাসিনা যে কয়েকবার কথা বলেছেন, প্রত্যেকবারই দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলেছেন এবং দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে তার এবং তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেছেন।

নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ব্যর্থ বাণিজ্যমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখেননি। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে সিন্ডিকেটের ব্যাপারে তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রীর অসহায়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরার কথা বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েই তাকে ধরেছেন। শেখ হাসিনা এবার আস্থা রেখেছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ আহসানুল ইসলাম টিটুর ওপর।

নিত্যপণ্যের দাম এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মানুষের জীবনমান যেখানে পৌঁছেছিল, এক ধাক্কায় সেইখান থেকে অনেকটাই নেমে এসেছে। জীবনমান উন্নয়নের কৃতিত্ব যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের, জীবনমান নেমে যাওয়ার দায়ও আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।

শপথের পর প্রথমদিন অফিস করতে গিয়েই বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু দ্রব্যমূল্য নিয়ে বৈঠক করেছেন। প্রথম দিনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, ‘আমার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম কর্মসূচিটি হবে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা।’ তিনি বলেছেন, ‘সরকার পণ্য উৎপাদন করে না, আমদানিও করে না। উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে সমন্বয় করে মাত্র। উৎপাদনকারীদের হাত থেকে পণ্যটি ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত জার্নিটা যেন স্মুথ হয়, সরকার সেই লক্ষ্যে কাজ করবে।’

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সবচেয়ে জরুরি যে কথাটা বলেছেন, তা হলো, বাংলাদেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। কেউ কোনো কারসাজি করে বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের চেষ্টা ও আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খালি কথায় চিড়া ভিজবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অনেক আগেই লাভ আর লোভের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছেন। সুযোগ পেলেই তারা মানুষকে জিম্মি করে, পণ্য মজুদ করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেন। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি জরুরি।

সৎ ব্যবসায়ীদের পাশে থাকতে হবে, অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আহসানুল ইসলাম টিটু নিজেও ব্যবসায়ী। তাই ব্যবসায়ীদের ফাঁকটা তিনি সহজেই ধরতে পারবেন। আশা করি তিনি আগের বাণিজ্যমন্ত্রীর মতো ব্যবসায়ীদের কাছে নিজেই জিম্মি হয়ে যাবেন না। মুশকিলটা হলো, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা জোট বেঁধে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চায়। তবে এই ভয়ে তাদের ছাড়ও দেওয়া যাবে না। ভারসাম্যটা খুব জরুরি।

আগের মেয়াদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিলেন। সিন্ডিকেটের কাছে নিজের অসহায়ত্ব স্বীকার করেছেন। ব্যবসায়ীরা কখনো ডিম, কখনো মুরগি, কখনো পেঁয়াজ, কখনো আলু নিয়ে খেলা করেছেন।

ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পুরোটা সরকারের হাতে থাকে না। তবে সময়মতো হস্তক্ষেপ করে, প্রয়োজনে শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন করে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আগে দেখা গেছে, দাম বাড়ার পর শুল্ক কমানো হয়। কিন্তু সেই কমানোর প্রভাব বাজারে পড়তে পড়তে বাজার স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আগে থেকেই বাজারে নজর রাখতে হবে।

কোন সময় কোন পণ্যের চাহিদা বাড়ে, তা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে। এখন যেমন রমজানের সময়কার পণ্য নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদিও এরই মধ্যে দেরি হয়ে গেছে, তবু রমজানে বাজার যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, তার চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করতে হবে।       

আমদানি করা পণ্যের দাম না হয় ডলারের দামের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম কেন হুটহাট বাড়ে, সেইটা তদন্ত করে বের করতে হবে। ভরা মৌসুমেও কেন চালের দাম বাড়বে, কেন আলু, পেঁয়াজ, ডিম, সবজি নিয়ে কারসাজি হবে। কৃষক যে ফুলকপি ৫ টাকায় বিক্রি করে, তা কেন আমাদের ৫০ টাকায় কিনতে হয়; এই জবাব খুঁজে বের করতে হবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীকে।

মাঝের ৪৫ টাকা কোথায় যায়, কে পায়; তা বের করতে পারলেই দাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এই যে পথে পথে চাঁদাবাজি, পদে পদে দুর্নীতি; এটা বন্ধ করতে পারলেই দাম কমানো সম্ভব। আর উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বলে নয়, প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগাতে পারলে, এমনিতেই সরবরাহ বেড়ে যাবে। আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে, এটা সহজ সূত্র।

এটা আমরা জানি, সরকার যতই আন্তরিক হোন, রাতারাতি পরিস্থিতি বদলে যাবে না। সেইটা বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীও জানেন। প্রথম দিনেই তিনি বলেছেন, ‘কোনো ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষার জন্য নয় জনস্বার্থে কাজ করবো। সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সেই কাজ করবো। ভোক্তাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমাকে একটু সময় দেন।’

চেষ্টায় আন্তরিকতা দেখলে সময় দিতে আপত্তি নেই। তবে সময়টা যেন সাধারণ মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে না যায়। তবে শেষ কথা হলো, কথায় বাজারদর কমবে না, ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে শক্ত হাতে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ