ছবি : সংগৃহীত

আমি যখন স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনকার চলচ্চিত্র জগতের পরিচালক ও অভিনয় শিল্পীদের প্রায় কাউকেই রাজনীতিতে দেখিনি। তারা তাদের জগৎ নিয়েই থাকতো। তাদের কাউকে কখনো ট্রাকে করে ঘুরে ঘুরে কোনো দলের হয়ে কিংবা কোনো ব্যক্তির হয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামতে হতো না। এই চিত্র আমি দেখিনি।

তখনকার শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক কিংবা ব্যবসায়ীদের কাউকে রাজনীতি করে এমপি মন্ত্রী হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে দেখিনি। তখনকার সেরা শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী ছিলেন ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুল ইসলাম যিনি কোনোদিন রাজনীতি করেননি। সব দলকেই টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন।

ছোটবেলায় দেখতাম সরকারি কর্মকর্তাদের আয়োজনে কোনো সভা ডাকলে দলমত নির্বিশেষে এলাকার সব গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। প্রশাসন তখনো রাজনীতিকরণ হয়নি।

আমাদের শিক্ষকদের কাউকে তেমন রাজনীতি করতে দেখিনি। যারা করতেন তারা আদর্শের জন্য করতেন। ক্ষমতা কিংবা অর্থের জন্য কাউকে রাজনীতি করতে দেখিনি। কিন্তু এখন যখন দেখি, টক-শোতে গিয়ে শিক্ষকরা মিথ্যা কথা আর দলবাজি করে তখন বোঝা যায় রুচির দুর্ভিক্ষ আর অনৈতিকতা আজ মহামারি আকার ধারণ করেছে।

অভিনেতার অভিনয় ক্যারিয়ার শেষ হয়নি কিন্তু এমপি হওয়ার লটারির টিকেট কিনছেন, খেলোয়াড়ের খেলার ক্যারিয়ার শেষ হয়নি কিন্তু এমপি হওয়ার লটারির টিকেট কিনছেন, ব্যবসায়ীর ব্যবসার ক্যারিয়ার এখনো পুরোদমে শুরুই হয়নি কিন্তু এমপি হওয়ার লটারির টিকেট কিনছেন, শিক্ষকের ভিসি হওয়ার মেয়াদ শেষ হয়নি কিন্তু এমপি হওয়ার লটারির টিকেট কিনছেন, সাধারণ শিক্ষকের শিক্ষকতার ক্যারিয়ার এখনো শুরুর দিকে কিন্তু এমপি হওয়ার লটারির টিকেট কিনছেন।

বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও তলানিতে। অথচ আমরা উন্নত হয়ে গেছি বলে বড়াই করি। একজন শিক্ষামন্ত্রী যদি এইটা না বোঝেন তাহলে এই জাতির সত্যিকারের উন্নতি কীভাবে হবে?

সবাই লটারির জ্যাকপট পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন। সবাই ট্যাক্সফ্রি গড়ি পেতে চান, অন্যায় করে মাফিয়া লিডার হতে চান, দ্রুত অর্থ ক্ষমতা পেতে চান। লজ্জাহীন ও বিরামহীনভাবে ছুটছেন এই মোহের পেছনে। এদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়?

শুধু এদের কেন, কোন এমপি, কোন মন্ত্রণালয় পেলেন তাতে কি কিছু আসে যায়? সবাই তো সবকিছু করবেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই। সেই নির্দেশ কবে আসবে সেই পর্যন্ত তারা বসে থাকেন। যেন নির্দেশ না আসলে তারা কিছুই করতে পারেন না।

ভালো কাজের জন্য কোনো সৃষ্টিশীল আইডিয়াও তাদের মাথায় আসে না। বরং সৃষ্টিশীল কিছু না ভাবতে ভাবতে মাথা ভোঁতা হয়ে গেছে। চাতক পাখির মতো কেবল নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকাই যেন আমলা মন্ত্রীদের কাজ। তাই কে, কোন মন্ত্রণালয় পেল তাতে কিছুই আসে যায় না।

এখানে কারও মাথা দিয়ে ভালো আইডিয়া আসলেও সেই আইডিয়ায় কাজ করে সুফল পেলে সেই কাজের ক্রেডিট হাইজ্যাক হয়ে যায়। অফিসের কর্মচারীরা করলে তাদের বস ক্রেডিট হাইজ্যাক করেন, বস করলে তার বস সেই ক্রেডিট হাইজ্যাক করেন। এইরকম একটা রাষ্ট্রীয় পরিবেশে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। হতে পারে না।

যেমন নতুন শিক্ষামন্ত্রীকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে, ‘শিক্ষায় আমাদের বাজেট বরাদ্দ খুব কম আপনি কি এই বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নিবেন কি না?’ শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে আমি চরমভাবে হতাশ! তিনি এর উত্তরে বলেছেন যে বরাদ্দ কম না! যেই বরাদ্দ দেওয়া হয় সেইটা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না বা সেইখানে দুর্নীতি হয়!

তিনি বলেছেন যতটা দেওয়া হয় সেইটা যেন অপচয় বা দুর্নীতি না হয় তার চেষ্টা করবেন! শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর একটা নির্দেশনা আছে যে, একটি দেশ যেন তার জিডিপির অন্তত ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। সেই জায়গায় আমরা দিয়েছি ১.৭৬ শতাংশ! কল্পনা করতে পারেন? অথচ ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়ার মতো দেশ এখন ৫.৪ শতাংশ বা তার আশেপাশে বরাদ্দ দেয় এবং তার সুফল তারা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছে।

২০০০ সালেও ভিয়েতনামের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং-এ ১০০০ এর মধ্যেও ছিল না। এখন তাদের দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় ৫০০-এর মধ্যে চলে এসেছে। তাছাড়া শহরের মানুষদের আচরণের মধ্যে সভ্য মানুষের ছাপ সুস্পষ্ট। যেটা আমাদের ঢাকা শহরে দেখা যায় না। এখনো ঢাকা শহর প্রাচীন শহরের মতো।

বাংলাদেশে যে আজকে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র দেখছি তার শুরু কিন্তু শিক্ষকদের দুর্নীতি দিয়েই। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে উন্নত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

শিক্ষায় কম বরাদ্দের সবচেয়ে বড় ভিকটিম হলো শিক্ষকরা। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও তলানিতে। অথচ আমরা উন্নত হয়ে গেছি বলে বড়াই করি। একজন শিক্ষামন্ত্রী যদি এইটা না বোঝেন তাহলে এই জাতির সত্যিকারের উন্নতি কীভাবে হবে?

হ্যাঁ, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি অন্য সব দুর্নীতির চেয়ে ক্ষতিকর। তাই এইটা বন্ধ করতে হবে। কারণ এই ক্ষতি ভোগ করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মে, চক্রবৃদ্ধি আকারে। তাই এই ক্ষতি যারা করে তারা ক্ষমার অযোগ্য। তারা দেশদ্রোহী।

বাংলাদেশে যে আজকে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র দেখছি তার শুরু কিন্তু শিক্ষকদের দুর্নীতি দিয়েই। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে উন্নত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত শিক্ষকরাই পারে উন্নত মানুষ তৈরি করতে। আর উন্নত মানুষ পারে উন্নত জাতি তৈরি করতে। উন্নয়নের এইটাই সবচেয়ে টেকসই মডেল।

একজন শিক্ষামন্ত্রীকে তো প্রথমে বলতে হবে আমাদের শিক্ষকরা এত কম বেতন এবং সম্মান পেতে পারেন না। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির কথা ভাবলেই তো শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একজন শিক্ষামন্ত্রী যদি মেরুদণ্ড সোজা রেখে সরকারের কাছে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর জোর দাবি জানাতে না পারেন সেই শিক্ষামন্ত্রী থাকা না থাকা একই কথা।

এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে বেশি ছিল। আজকে তাদের বেতন আমাদের প্রায় তিনগুণ। অথচ কলকাতায় বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে জিনিসপত্রের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। তাই কার্যকরভাবে তাদের বেতন আমাদের চেয়ে চারগুণ বেশি! তাহলে আমরা কীভাবে ভালো মানের শিক্ষক পাব? ভালো মানের শিক্ষক পেলেও কীভাবে তাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবো? এই সবই রাজনীতির ফল। তাই আগে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা জরুরি। তা কবে হবে?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়