ছবি : সংগৃহীত

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন—‘বই পড়া শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাই নে। প্রথমত, সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না। কেননা, আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই; দ্বিতীয়ত, অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন। কেননা, আমাদের এখন ঠিক শখ করার সময় নয়। আমাদের এই রোগশোক, দুঃখ-দারিদ্র্যের দেশে সুন্দর জীবনধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সে জীবনকেই সুন্দর করা, মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছে নিরর্থক এবং নির্মমও ঠেকবে।’

সৈয়দ মুজতবা আলী যখন ‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি লেখেন, তখনো মানহীন বই বাজার দখল শুরু করেনি। তবে এখনকার চিত্র ভিন্ন। গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাশাপাশি প্রকাশিত হচ্ছে প্রচুর মানহীন বই। এই সত্যটি বেশি স্পষ্ট হয় বইমেলার সময়।

প্রতি বছর বইমেলায় নতুন লেখকের আবির্ভাব ঘটে। নতুন প্রকাশনা সংস্থাও হাজির হয়। কোনো সন্দেহ নেই, নতুন লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্ম সুসংবাদ। কিন্তু এটি দুঃসংবাদে রূপান্তরিত হয় যদি প্রকাশিত বইয়ের মান নিম্নগামী হয়। মানহীন বইয়ের সংখ্যা যদি মহামারি আকার ধারণ করে, তখন বইমেলা শুধু ধূলিদূষণ নয়, বইদূষণেরও শিকার হয়। ২০২৪ সালের বইমেলাতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বই ছাপে, বই প্রকাশ করে না। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মানে ছাপাখানা নয়। সুসম্পাদিত না হয়ে কোনো বই প্রকাশিত হওয়া উচিত হয়। এটা নিশ্চিত করবে কে? লেখক, পাঠক না বাংলা একাডেমি? কেউ দায় এড়াতে পারে না।

বছরের পর বছর মানহীন বই প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু প্রকাশকের সাথে গুণমানহীন লেখকের সমঝোতার কারণে। এই প্রতিষ্ঠান ও লেখক চিহ্নিত করা কোনো দুরূহ বিষয় নয়। বইমেলায় স্টল বরাদ্দ করার সময় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে কঠোর হতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বইয়ের প্রচারকে সহজলভ্য করে দিয়েছে। ফেসবুক, টিকটকসহ নানা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিচিত্র ধরনের বই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোনো কোনো গণমাধ্যমের বাছবিচারহীন প্রচারের কারণে গুরুত্বহীন বই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ভালো বই চলে যায় দৃষ্টির অন্তরালে।

যেকোনো বই জীবনকে সুন্দর ও মহৎ করতে পারে না। বৈভবমণ্ডিত সেই বইগুলো যেন পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়, এটি নিশ্চিত করা জরুরি। 'প্রচারেই প্রসার'—এই আপ্তবাক্যের অপব্যবহার কাম্য নয়। অথচ বইমেলাকে উপলক্ষ করে এমন অপব্যবহার হরহামেশা ঘটছে।

অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বই ছাপে, বই প্রকাশ করে না। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মানে ছাপাখানা নয়। সুসম্পাদিত না হয়ে কোনো বই প্রকাশিত হওয়া উচিত হয়। এটা নিশ্চিত করবে কে?

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বইমেলায় দর্শনার্থীর অভাব নেই, ছুটির দিনগুলোয় উপচে পড়া ভিড়। বলাবাহুল্য এদের অধিকাংশই পাঠক নয়, নিছক দর্শক। বইমেলা তাদের কাছে উচ্চস্তরের বিনোদন ছাড়া কিছু নয়।

বিভিন্ন স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, ক্ষেত্রবিশেষে শুধু ছবি তোলার জন্য বই হাতে পোজ দিয়ে আবার বইটি স্টলে ফেরত দেওয়ার দৃশ্য দুর্লভ নয়। আমি অজস্র দর্শনার্থীকে বই কেনা ছাড়াই মেলা থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছি। অথচ তাদের বিপুল সংখ্যক উপস্থিতি বইয়ের ক্রেতা ও পাঠকদের স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে।

একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে এই পরিস্থিতির মধ্যে ভালো বই শনাক্ত করা কষ্টসাধ্য। খ্যাতিমান প্রকাশকদের দুঃখ প্রকাশ করে বলতে শুনেছি, সবচেয়ে মানসম্পন্ন বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ কম; হালকা, অগভীর বইয়ের চাহিদা বেশি। অনুসন্ধিৎসু, মননশীল পাঠক নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু তাদের কাছে প্রকৃত বইয়ের খবর না পৌঁছানো কিংবা সস্তা, চটকদার বইয়ের পাঠক বৃদ্ধি বই বিপণনের ব্যর্থতাকেই প্রকট করে তোলে।

ভালো বইকে পাঠক সাধারণের দৃষ্টিগোচর করার ক্ষেত্রে বই আলোচনা তথা সাহিত্য সমালোচনা অত্যন্ত জরুরি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমালোচনা সাহিত্য এখনো তার দারিদ্র্য ঘোচাতে পারেনি। সমালোচনা সাহিত্য শুধু সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা নয়, গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রসারেও এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

খ্যাতিমান প্রকাশকদের দুঃখ প্রকাশ করে বলতে শুনেছি, সবচেয়ে মানসম্পন্ন বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ কম; হালকা, অগভীর বইয়ের চাহিদা বেশি।

সারা বছর বই প্রকাশের রীতিতে এখনো অভ্যস্ত হতে পারেনি আমাদের প্রকাশনা শিল্প। গুটিকয়েক ব্যতিক্রম বাদে ফেব্রুয়ারির বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে প্রকাশনা সংস্থাগুলো। অধিকাংশ লেখকের জন্যও এটি প্রযোজ্য। নিজের গুরুত্বপূর্ণ বইটি প্রকাশের জন্য তারাও বেছে নেন ফেব্রুয়ারি মাসকে। পাঠকও এর বাইরে নন। স্বল্প সংখ্যক পাঠকই সারা বছর বইয়ের খবর রাখেন। এই অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে দেশের প্রকাশনা শিল্প পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারবে না।

যদি সারা বছর নিয়মিতভাবে বই প্রকাশিত হয়, তবে এর সুফল বইমেলার সময় পাওয়া যাবে। বইমেলার সময় তড়িঘড়ি করে বই প্রকাশের প্রবণতা অনেক লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে কাজ করে। এর কুফল দেখা যায় ভুল ভ্রান্তিতে ভরা বইয়ের মধ্যে।

বই মানুষকে চিন্তাশীল করে, তার ভেতরে শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটায়। প্রায় শতবর্ষ আগে প্রকাশিত 'শিখা' পত্রিকার মর্মবাণী ছিল—‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ভাঙতে পারলে মুক্তবুদ্ধির বিস্তার ঘটে এবং অন্ধকার থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হয়।

এক্ষেত্রে বইমেলা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি আশার কথা যে, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বইমেলা এখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু বইমেলার সুফল অর্জিত হবে না, যদি মানহীন বই ও প্রকাশনা সংস্থার ভিড়ে প্রকৃত বই হারিয়ে যায়।

বইয়ের গুণগত মান যদি বৃদ্ধি না পায়, তবে এটি শুধু লেখক-প্রকাশকের জন্য নয়, জাতি হিসেবেও আমাদের নিদারুণ ব্যর্থতা গণ্য হবে। বই পড়া, বই কেনার পরামর্শ এখন আর যথেষ্ট নয়। জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, মানসম্পন্ন বই ও পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না।

হঠাৎ কোনো বিদেশি নাগরিক অমর একুশে বইমেলায় তীব্র জনস্রোত দেখে চমকে যাবেন। মনে মনে হয়তো ভাববেন এমন পাঠমনস্ক জাতি অত্যন্ত বিরল। আসলেই কি তাই? ছুটির দিনগুলোয় রীতিমতো যুদ্ধ করে বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতে হয়।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় তখন বলতে ইচ্ছে করে, ‘সহেনা সহেনা জনতার জঘন্য মিতালী।’ বিপুল জনতা বীরদর্পে ফিরে আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো বই না কিনে। এই অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন ঘটবে-এমন প্রত্যাশা না করাই ভালো। ধীরে ধীরে পরিবর্তনটুকু ঘটাতে হবে।

এই ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি ও প্রকাশকদের মধ্যে এই বোঝাপড়াটুকু থাকতে হবে যে, বইয়ের গুণগত মানের প্রশ্নে কোনো পক্ষ আপস করবে না। এতে দর্শনার্থীর পাশাপাশি পাঠকসংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই বিশ্বের বুকে মাসব্যাপী চলমান একমাত্র বইমেলা আয়োজন আরও সার্থকতা খুঁজে পাবে।

রাজীব সরকার ।। প্রাবন্ধিক