ছবি : সংগৃহীত

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কী ঘটছে? পত্রিকায় পাতা, টেলিভিশন কিংবা অনলাইনের পর্দায় চোখ রাখলে পৃথিবীর মানুষ নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেন! বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি তবে যৌন নিপীড়নের উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠছে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষক কেউই বাদ যাচ্ছেন না এই হয়রানি থেকে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলবো? প্রায় সব জায়গায় তো একই চিত্র। কোনোটার নাম গণমাধ্যমে আসে, কোনোটা আসে না। আমাদের শিক্ষকেরা নারী শিক্ষার্থীদের পেতে চান ‘জিরো ডিসটেন্সে’।

পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ার কিংবা ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের। পুরুষ শিক্ষকেরা নারী শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি করেন। কথায়-আচরণে যৌন নিপীড়ন করেন। কিন্তু এমন তো হওয়ার ছিল না! বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে গবেষণার উর্বর স্থান—এই স্বাভাবিক চাওয়াটা মাথা কুঁড়ে মরছে কোথাও। অথচ শিক্ষকেরা এবং কতিপয় ছাত্র নেতারা হয়ে গেলেন যৌন নিপীড়ক দানব-একেকজন।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গৃহবধূকে ক্যাম্পাসে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করল এক ছাত্রনেতা। আর এই অপকর্মে তাকে সহায়তা করল, তারই সংগঠনের আরও কয়েকজন। ছাত্র সংগঠনের নাম কেন বলছি না, সেই প্রশ্ন তুলছেন? সংগঠনটি অবশ্যই ছাত্রলীগ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষক কেউই বাদ যাচ্ছেন না এই হয়রানি থেকে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলবো? প্রায় সব জায়গায় তো একই চিত্র। কোনোটার নাম গণমাধ্যমে আসে, কোনোটা আসে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহবধূ ধর্ষণের পর কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসার পুরনো চিত্র দেখতে পাই আমরা। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগ দুই বহিরাগতকে গ্রেফতারের পর র‌্যাব জানায়, ক্যাম্পাসে নিয়মিত মাদক ও নারী সরবরাহ করতো এই চক্র।

কাদের কাছে সরবরাহ করতো? প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ও শিক্ষকদের কাছে! এরপর আর কী বলার থাকে? র‌্যাবের দেওয়া এই তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে কতটা ভয়াবহতার মাঝে আছি আমরা, তা কি ব্যাখ্যা করে বলার কোনো প্রয়োজন আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির। তিনি নাকি নিয়ম করে বিভিন্ন ছাত্রীদের আপত্তিকর বার্তা পাঠাতেন। তা নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা চলছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক নাদির জুনাইদের পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করছেন। 

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী পাঁচ বছরে দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১টি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ সামনে এসেছে। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে সাতটি ঘটনা ঘটেছে।

এগুলো হলো প্রকাশ্যে আসার অভিযোগ। আরও এমন কত যৌন নিপীড়নের ঘটনা আছে যেগুলো অভিযোগ আকারে আসেনি, তার তো কোনো হিসাবই নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ অভিযোগ হিসেবে আসে। বাকিগুলো আসে না কেন?

কারণ যে ১০ শতাংশ ঘটনা অভিযোগ হিসেবে আসে তার বেশিরভাগই নিষ্পত্তি করে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কেন নিষ্পত্তি করে না? তার কিছুটা জবাব দিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যৌন নির্যাতন–সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসা এই শিক্ষক বলেন, ‘উপাচার্য কে—তার ওপর যৌন নিপীড়নের বিচার পাওয়া না পাওয়াটা নির্ভর করে। উপাচার্যদের নিজেদের ক্যাডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে আর পাঠান না।’

যে জনগণের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সেই জনতার সন্তান নিপীড়িত হলে প্রশাসনের কারও কিছুই যায় আসে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠনের কথা আছে...

৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদনের বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু কে যাবে রিট করতে? শিক্ষক সমিতিরও অ্যাজেন্ডা থাকে।’ ২০২৩ সালের ৮ জুন মহিলা পরিষদ আয়োজিত—‘নারী বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন : বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক এই মন্তব্য করেছিলেন।

আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয় না? কারণ অভিযুক্তদের প্রায় সবাই ক্যাম্পাসে নানাভাবে প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। কেউ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা, কেউ বা ক্যাম্পাসের শিক্ষক রাজনীতিতে খুব প্রভাবশালী হয়ে থাকেন। সুতরাং উপাচার্য মহোদয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের কখনোই খুব একটা ঘাটান না। কারণ উপাচার্যদের চেয়ারের খুঁটি তো তারাই আগলে রাখেন। রাজা উজির মারার সেই যুদ্ধে কোনো চুনোপুঁটি শিক্ষার্থী কিংবা নারী শিক্ষকের অভিযোগে কান দিতে তাদের বয়ে গেছে!

এসব অভিযোগকারীরা তো উপাচার্য কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতার স্বাদ দিতে পারবেন না। বরং যারা ক্ষমতার স্বাদ দিতে পারেন তাদের তোয়াজ করে চলাই ভালো। যে জনগণের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সেই জনতার সন্তান নিপীড়িত হলে প্রশাসনের কারও কিছুই যায় আসে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠনের কথা আছে।

সেই সেলও আছে। সেইখানে অভিযোগ জমা পড়লে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই অভিযোগ সিন্ডিকেট সভায় তোলে না। ফলে অভিযোগের নিষ্পত্তিও হয় না। এভাবেই সময় যায়। আর অভিযোগকারী শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবন শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। আর নিপীড়ক নতুন কাউকে খুঁজে নেয় নিপীড়নের জন্য। 
তাহলে গলদ কোথায়? কে এই গলদের গোঁড়া ধরে টান দেবে?

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী