ছবি : সংগৃহীত

নিত্যপণ্যের অতিমূল্য নিয়ে কয়েকদিন ধরে কিংবা অনেক দিন ধরেই বিবিধ কথা হচ্ছে। পত্রপত্রিকা টেলিভিশনগুলো বিরামহীন প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে এমন খবরও দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে।

কোনটার কত দাম তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমি দৃষ্টি দিতে চাই অন্য বিষয়ে। কয়েকদিনের খবরগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য কিংবা সহনীয় মাত্রায় আনার জন্য বাজারে তৎপরতা দেখানোর চেষ্টা চলছে—বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাজার মনিটরিং টিম।

এছাড়া জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি এবং ক্যাবের সদস্যরাও সহায়তা প্রদান করছেন।

সরকারের যত ধরনের সংস্থা আছে, প্রায় সবাই কাজে নেমেছে পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলোরও সহায়তা দিচ্ছে। এছাড়া বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীসহ অন্যরা প্রায় প্রতিদিনই বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবুও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না!

তাহলে কি অতি মুনাফাখোররা এতই শক্তিশালী? এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেলেই মিলবে সমাধান। কিন্তু এর উত্তর আপনাকে কে দেবে? কেউ না। তারচেয়ে বরং আপনাকে শোনানো হবে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারেও বেড়ে গেছে পণ্যের দাম।

সুতরাং দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি যদি কিছুটা সাহস নিয়ে মিনমিনে গলায় হলেও পাল্টা প্রশ্ন করেন, যেসব পণ্য দেশেই উৎপাদিত হয়, বাইরে আমদানিও করতে হয় না, তারও কেন আগুন দাম?

অথবা আপনি যদি প্রশ্ন করেন, সয়াবিন তেলের দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়ার এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও এখনো কেন বাজারে দাম কমলো না?

....সাহস নিয়ে মিনমিনে গলায় হলেও পাল্টা প্রশ্ন করেন, যেসব পণ্য দেশেই উৎপাদিত হয়, বাইরে আমদানিও করতে হয় না, তারও কেন আগুন দাম?

দোকানদাররা কেন অজুহাত দেন আগের দামে কেনা সয়াবিন এখনো রয়ে গেছে, তাই নতুন নির্ধারিত কম দামে বিক্রি করতে পারছেন না। কিন্তু যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ার ঘোষণা আসে তখন কেন দোকান থেকে আগের কম দামে কেনা তেল হাওয়া হয়ে যায়? সেই প্রশ্নের উত্তরও আপনি কারও কাছে পাবেন না। এ বড় জটিল অঙ্ক। এসব হিসাব মেলানো আপনার আমার সাধ্যের মধ্যে নেই।

আসল কথা কি জানেন? পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসুক এটা কি সংশ্লিষ্টরা আসলেই আন্তরিকভাবে চান? যদি চাইতেন, তাহলে কোনোভাবেই পণ্যের অতিরিক্ত বেহায়া মূল্যে লাগাম পরানো সম্ভব না, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।

তারচেয়ে বরং অন্য আলাপে যাই। প্রিয় পাঠক একটা বিষয় খেয়াল করেছেন কি? এবারের রোজায় বিদেশি খেজুর আমাদের দেশি বেগুনের ইজ্জত একেবারেই মেরে দিয়েছে! যদিও বেগুন তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবুও খেজুরের কাছে সে এখন পিছিয়ে আছে। কীভাবে?

বুঝিয়ে বলছি। রোজা আসার আগেই এবার খেজুর কেজিতে হাজার টাকা ছুঁয়েছে—তা নিয়ে চলছে ব্যাপক হট্টগোল। খেজুর, আঙুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এরমধ্যে এক মন্ত্রী ফলটির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন আরও কয়েকগুণ। আরেক মন্ত্রী এবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে না পারার ক্ষোভেই হোক, অথবা অন্য কোনো কারণেই সেই খেজুরওয়ালা মন্ত্রীকে আচ্ছা মতো গালাগাল দিয়ে পুরো বিষয়টাকে একেবারে ক্ল্যাসিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

এই সবের আমাদের বেগুন নিজের দাম ৬০ টাকা কেজি থেকে ১২০ টাকা, কোথায়ও ১৫০ টাকায় নিয়েও খেজুরের মতো অতটা লাইমলাইট পেল না এবার। অথচ রোজা এলে বরাবর ফোকাস থাকার কথা বেগুনের ওপর। এবং বেগুন দিয়েই কেন বেগুনি খেতে হবে?

পেঁপে, আলু কিংবা মিষ্টি কুমড়া দিয়েও তো বেগুনি খাওয়া যায়—সেই বক্তব্য শোনার সুযোগও এবার হলো না! সত্যি, বেগুনের জন্য খুব আফসোস হচ্ছে এবার!

...সরকারের যত ধরনের সংস্থা আছে, প্রায় সবাই কাজে নেমেছে পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।  তবুও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, কেন?

আচ্ছা থাক, বেগুনের আলাপ বাদ। এবারের রমজানে সবাই যখন ব্যস্ত লেবুর হালি নিয়ে, তখন নীরবে নিভৃতে তেলেসমাতি দেখিয়ে দিয়েছে অতি নিরীহ ইসবগুলের ভুষি। কেজিতে নাকি ৫০০ টাকা দাম বেড়েছে তার! বুঝুন অবস্থা? ইসবগুল নাকি কোষ্ঠকাঠিন্য ভালো করে। এখন তো দেখি দাম শুনেই উল্টো কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার জোগাড়!

এই তো কিছুদিন আগে মুকেশ আম্বানি নামে এক ভদ্রলোক, হাজার কোটি টাকা খরচ করে ছেলের বিয়ে দিলেন। তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে কত কথা! কেউ বলছেন টাকা থাকলেই এমন লোক দেখানো খরচ করতে হবে নাকি? তাদের মতে এসব মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়েতে হাজার কোটি টাকা খরচ যদি মধ্যযুগীয় বর্বরতা হয় আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা শুধু রমজান মাসে যা করে তা কী?

পৃথিবীর অন্য দেশ যেখানে বিভিন্ন উৎসব, পার্বণে বড় বড় ছাড় দেয় সেই জায়গায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ধর্মকে পুঁজি করে কীভাবে হরিলুট করবে সেই আশায় ব্যস্ত থাকে।

তবে কথা হলো, খেজুর হোক গুড় হোক কিংবা চিনি অথবা অন্য পণ্য—অস্বাভাবিক মাত্রায় দাম বেড়ে গেলে পণ্যটি বর্জন করুন। দেখুন মজুদদাররা কয়দিন টেকে। যাদের হাতে অনেক টাকা যারা হাজার টাকা কেজি হলেও খাবে, লাখ টাকা কেজি হলেও খাবে। কিন্তু সমাজে লাখপতি কোটিপতি খুব বেশি নয়। বরং মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষই বেশি। সুতরাং তারা যদি স্রোতে গা না ভাসান সমাজ থেকে অরাজকতা এমনিতেই কমে যাবে।

পুনশ্চ, একটা কথা বলে রাখি। শুধু এই রমজানের অর্ধেক যেতে দিন কিংবা পুরোটা, দেখবেন অনেক গোডাউন থেকে পচা খেজুর বের হবেই হবে, যেগুলো অতি লাভের লোভে জমিয়ে রেখেছিলো মজুতদাররা।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী