ছবি : সংগৃহীত

কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির সংস্কৃতি আমাদের সব সরকারি অফিসেই কম বেশি আছে। বলা হয়, সরকারি চাকরি হওয়া যেমন কঠিন, যাওয়াও কঠিন। তাই দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকে বা বিলম্বিত উপস্থিতি সত্ত্বেও অনেকে বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছেন।

সব সরকারি অফিসে সাধারণ মানুষের যেতে হয় না। তাই সব অনুপস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথা ব্যথাও নেই। কিন্তু যেসব অফিসে সাধারণ মানুষের যেতে হয়, সেইখানে তাদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়।

পাসপোর্ট, বিআরটিএ, ভূমি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ব্যাংক—যেখানেই যান, হয় সময়মতো মানুষ পাবেন না, পেলেও হয়রানি পোহাতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় ডাক্তারদের অনুপস্থিতি নিয়ে। এই আলোচনাটা সবচেয়ে বেশি যৌক্তিক। কারণ ডাক্তারদের পেশাটা আর সবার মতো নয়।

ডাক্তারদের থাকা না থাকার সাথে মানুষের জীবন মরণের সম্পর্ক। অন্য সব কর্মকর্তাদের থাকা না থাকার সাথে মানুষের হয়রানি, ভোগান্তি, আর্থিক ক্ষতি সম্পৃক্ত। কিন্তু সময়মতো ডাক্তার না পেলে মানুষ মারাও যেতে পারে। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়ার’ গল্প তো আমরা ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি।

এটা ঠিক ডাক্তারদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি হলেও বাস্তবে তাদের সুবিধা সবচেয়ে কম। ছাত্রজীবনে মেধাবীরাই ডাক্তারি পড়ার সুযোগ বেশি পান। কিন্তু পড়াশোনা শেষে বিসিএস দিয়ে যখন চাকরি জীবন শুরু করেন, তখন বেশি মেধাবী ডাক্তাররা সুবিধা পান সবচেয়ে কম। আর তুলনামূলক কম মেধাবী প্রশাসন বা পুলিশ কর্মকর্তারা সুবিধা পান সবচেয়ে বেশি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এমনকি থানার ওসির তুলনায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চুনোপুঁটি মাত্র। উপজেলা পর্যায়ে থাকা বা পরিবহনের জন্য একজন ডাক্তারকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। দিনের পর দিন এই বঞ্চনা থেকেই ডাক্তাররা মফস্বলে থাকতে চান না, মূল কাজ বাদ দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি মনোযোগী হন।

ডাক্তারদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, বঞ্চনা দূর করার দাবি তারা করছেন; আমরাও তাদের দাবির সাথে একমত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও একজন ডাক্তার। তাই ডাক্তারদের বেদনাটা তিনি সবচেয়ে ভালো বুঝবেন। কিন্তু সমস্যা যতই থাকুক, সময়মতো হাসপাতালে উপস্থিত থাকতে হবে, রোগীদের সেবা দিতে হবে। এখানে কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য নয়। সব সমস্যা জেনেই তারা এই পেশা, এই চাকরি বেছে নিয়েছেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউনিয়ন পর্যায়েও স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা পেলে অনেক মানুষের জীবন বাঁচতো। কিন্তু সময়মতো ডাক্তার না পেতে পেতে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।

আমাদের দেশে সবকিছুই কেন্দ্রীভূত, বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাটাই আমাদের মধ্যে নেই। বাংলাদেশের ভালো সবকিছু আছে ঢাকায়। তাই মানুষ কথায় কথায় ঢাকায় ছুটে আসে। ছোটখাটো অসুস্থতায়ও ঢাকায় ছুটে আসার এই প্রবণতা গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। এটা হয়েছে আসলে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা থেকে।

তাদের শঙ্কা, স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে যদি ডাক্তার না পান, যদি ভালো চিকিৎসা না পান; তাহলে তো তার প্রাণ সংশয় হতে পারে। তাই তারা স্থানীয় হাসপাতালে না গিয়েই ঢাকায় ছুটে আসেন। অথচ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউনিয়ন পর্যায়েও স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা পেলে অনেক মানুষের জীবন বাঁচতো। কিন্তু সময়মতো ডাক্তার না পেতে পেতে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা এখন কিছু হলেই ঢাকায় ছুটে আসে।

আমাদের নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন নিজেও একজন ডাক্তার। তিনি একজন জনদরদী, অন্যরকম ডাক্তার। একক চেষ্টায় দাঁড় করিয়েছেন বার্ন ইন্সটিটিউট। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এই বার্ন ইন্সটিটিউট করতে গিয়ে কী ধরনের হয়রানির মুখে পড়েছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে তৃতীয় ডাক্তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সামন্ত লাল সেন চিকিৎসা খাতের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালোই জানেন। ঢাকার এক অনুষ্ঠানে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদে গেলে সংসদ সদস্যরা আমাকে বলেন তার এলাকায় চিকিৎসক থাকে না। যেখানেই যাই, সেখানেই হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না শুনতে পাই। এগুলো তো ভালো কথা না। উপজেলা হাসপাতালে যদি ডাক্তার থাকতে না চায়, তাহলে গ্রামের মানুষ কোথা থেকে ভালো চিকিৎসা পাবে?’ (প্রথম আলো, ০৫ মার্চ ২০২৪)

দেশে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ আছে ৩৫ হাজার ৫০৩টি। এর মধ্যে ৭ হাজার ৪৫৯ জনই বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি। অর্থাৎ কর্মরত চিকিৎসকের ২১ শতাংশকে কাজ করতে হয় না।

পরদিনই সিলেটের জৈন্তাপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে গিয়ে তিনি কর্তব্যরত চিকিৎসক পাননি। তাকে সাময়িক বরখাস্তও করেছেন। কিন্তু একজন ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত করে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। বদলাতে হবে পুরো সংস্কৃতটাই। ডাক্তারদের অনুপস্থিতিটা যেমন তিনি জানেন, ডাক্তারদের সমস্যাটাও নিশ্চয়ই জানেন। আশা করি তিনি ডাক্তারদের গ্রামে থাকার সমস্যাগুলো জানেন। তিনি নিশ্চয়ই সমস্যাগুলো সমাধান করবেন এবং শহর-গ্রাম সর্বত্র ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন। সময়মতো ডাক্তার কর্মস্থলে না থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।

কর্মস্থলে ডাক্তারদের অনুপস্থিতি নিয়ে যখন আলোচনা, তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি শিরোনাম আমাদের শঙ্কিত করে। ৯ মার্চ ২০২৪ দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল ‘চিকিৎসায় নেই ২১% চিকিৎসক’। দেশে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ আছে ৩৫ হাজার ৫০৩টি। এর মধ্যে ৭ হাজার ৪৫৯ জনই বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি। অর্থাৎ কর্মরত চিকিৎসকের ২১ শতাংশকে কাজ করতে হয় না।

বিভিন্ন কারণে ওএসডি করার বিধান আছে। স্বাস্থ্যখাতে তা ১০ ভাগ পর্যন্ত অনুমোদিত। কিন্তু ওএসডি করা হয়েছে ২১ ভাগকে। সাধারণত উচ্চশিক্ষার জন্য, লিয়েনে ছুটি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য, পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি হলে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ওএসডি করা হয়।

আমাদের ডাক্তাররা চাকরি নিয়েই ঢাকায় বদলি হওয়ার জন্য তদবির শুরু করেন। না হয় নানা অজুহাতে ওএসডি হয়ে যান। ওএসডি ডাক্তারদের কাজ করতে হয় না, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা ঠিকই পান।

এখন ২১ ভাগ ডাক্তার যদি ওএসডি হয়ে কর্মস্থলে না থাকেন, তাহলে গ্রামের হাসপাতালে ডাক্তার পাওয়া যাবে কোথা থেকে? যারা বদলি বা ওএসডি হতে পারেন না, তারাও সময়মতো হাসপাতালে যান না। গেলেও ব্যস্ত থাকেন, চেম্বার বা বেসরকারি হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে। জৈন্তাপুর হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই সেইখানে বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

শুধু ডাক্তার নয়, অধিকাংশ সরকারি চাকরিজীবীদের শুরুটা করতে হয় মফস্বলের পোস্টিং দিয়ে। আজকে যিনি মুখ্য সচিব বা মন্ত্রিপরিষদ সচিব; তাকেও কিন্তু একসময় মফস্বলে চাকরি করতে হয়েছে। ইউএনও বা ডিসি বা এসপিকে কর্মক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি; এমন অভিযোগ কিন্তু বিরল।

আগেই বলেছি, আমাদের চিকিৎসা নেটওয়ার্ক তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলেই একটি স্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাহলে আর সবাই ঢাকায় ছুটে আসবে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য তৈরি হবে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ