ছবি : সংগৃহীত

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিছক আত্মজৈবনিক রচনা নয়, গত শতাব্দীর তিন দশকের বহুমাত্রিক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের, বিশেষ করে বাংলার, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বলা যায় পূর্ববাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ইতিহাসের অসংখ্য অনালোচিত উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই রচনায়।

বইটির হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি একরকম প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর প্রায় ২৯ বছর পরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঠিক পরপর। বইয়ের প্রথম প্যারাতেই প্রাককথনে কীভাবে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় তা জানানো হয়েছে—

‘শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা ২০০৪ সালে আকস্মিকভাবে তার কন্যা শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলি অতি পুরানো, পাতাগুলি জীর্ণ প্রায় এবং লেখা প্রায়শ অস্পষ্ট। মূল্যবান সেই খাতাগুলি পাঠ করে জানা গেল এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন যাকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও, এই বইটি তার সাক্ষর বহন করছে।’

গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীপারের একজন অতি সাধারণ পরিবার থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যেই দক্ষ রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে সুলিখিত ভাষায় এবং যুগপৎ ছিল তার বিনয় বোধ। ছিল না কোনো রাজনৈতিক আত্মঅহমিকা। অনেকটা নিষ্কপটভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন সবকিছু। বইটিতে এমন অনেক বিষয় ছিল যা সাধারণত আত্মজীবনীকাররা এড়িয়ে যান; কিন্তু এখানে কিছুই বাদ পড়েনি। বইটি পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হয় বিশ্বসাহিত্যের কোনো আত্মজৈবনিক উপন্যাস পড়ছি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বন্ধুবান্ধবরাই বিভিন্ন সময়ে তাকে তার রাজনৈতিক জীবনের কাহিনিগুলো লিখে রাখতে উৎসাহ এবং প্রেরণা দেন। এই প্রেরণা থেকেই তিনি যখন কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন তখন ১৯৬৭ সাল থেকেই আত্মজীবনীটি লেখা শুরু করেন।

এভাবেই জন্ম নেয় অসমাপ্ত আত্মজীবনী। পদ্মা, মধুমতি, আড়িয়ালখাঁ, কুমার তীরের এক সাধারণ পরিবারে, সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার প্রেরণাদীপ্ত গল্প; একজন জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা হয়ে ওঠার গল্প, একজন রাষ্ট্রনায়কের গল্প।

আমরা সবাই জানি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হলেন শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু প্রথম জীবনে তাকে প্রভাবিত করে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। এই সংযোগ হয় ১৯৩৬ সালে মাদারীপুর থাকা অবস্থায়। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালে মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হয়ে বদলি হয়ে আসেন (পৃষ্ঠা-৮)। বঙ্গবন্ধু তার পিতার সাথে মাদারীপুর চলে আসেন এবং মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন মাদারীপুর ছিল বিপ্লবী, অনুশীলন সমিতিদের ঘাঁটি। তাই এখানে এসেই তার মধ্যে বিপ্লবের মণিকাঞ্চন সংযোগটি ঘটে যায়।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বন্ধুবান্ধবরাই বিভিন্ন সময়ে তাকে তার রাজনৈতিক জীবনের কাহিনিগুলো লিখে রাখতে উৎসাহ এবং প্রেরণা দেন। এই প্রেরণা থেকেই তিনি যখন কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন তখন ১৯৬৭ সাল থেকেই আত্মজীবনীটি লেখা শুরু করেন।

এই বইটিতে অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে আছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাকে এই গ্রন্থের নায়কোচিত মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে। অনেক অধ্যায় জুড়েই বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেছেন সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন এবং আদর্শ; যার প্রভাব সরাসরিভাবে পড়েছে শিষ্য শেখ মুজিবুরের প্রতি যা তিনি সবিস্তারে বলেছেন বইয়ের বিভিন্ন অংশে। তিনি লিখেছেন—‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হলো। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’ (পৃষ্ঠা-১)

অসম্ভব শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার প্রকাশ পাওয়া যায় কথাগুলোর মধ্যে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই অন্ধের মতো সোহরাওয়ার্দীকে অনুসরণ করেননি শেখ মুজিবুর রহমান। ২/৩টি রাজনৈতিক বিষয়ে মতান্তর ঘটেছিল তার। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যখন গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন এমন হয়ে গিয়েছিল যে তার খাবার খাওয়ার টাকা পর্যন্ত ছিল না (পৃষ্ঠা-১২৯)। সেই সময় তাকে রাজনীতিতে একপ্রকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন শেখ মুজিবুর রহমান—এই কথাটি বললে খুব অত্যুক্তি হবে বলে মনে করি না।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সমাবেশ দেখা যায় বইয়ে। তবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরে আর একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর কথা বলা প্রয়োজন, তিনি হলেন মওলানা ভাসানী। বইয়ে পাকিস্তান ঘোষণার পরে থেকেই তার দেখা মেলে। তবে বিভিন্ন সময়ে দল বদল, মত বদলে ব্যস্ত ভাসানী সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধাযুক্ত বিরক্তি ছিল।

ভাসানী কোনো কাজ শুরু করে দিয়ে প্রয়োজনের সময় আত্মগোপন করে থাকতেন। অর্থাৎ দরকারের সময়ে তাকে পাওয়া যেত না (পৃষ্ঠা-২৫৫)। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সব কাজের শুরুতে তিনি আছেন, কিন্তু কর্মকাণ্ডের সময়ে বা বাস্তবায়নে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যার প্রমাণ অসংখ্য পাওয়া যায়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও আমরা এই কথার সত্যতা পায়। একজন মওলানা হয়েও ক্ষমতার লোভ, উদারতার অভাব বঙ্গবন্ধুকে আহত করেছে। তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ধারণা পায় লেখনীতেই—

‘রাতে এক বাড়িতে খেতে গেলেন মওলানা সাহেব। রাগ, খাবেন না। তিনি থাকতে কেন শামসুল হক সাহেবের নাম প্রস্তাব করা হল সভাপতিত্ব করার জন্য। এক মহাবিপদে পড়ে গেলাম। মওলানা সাহেবকে আমি বুঝাতে চেষ্টা করলাম, লোকে কি বলবে? তিনি কি আর বুঝতে চান? তাঁকে নাকি অপমান করা হয়েছে! শামসুল হক সাহেবও রাগ হয়ে বলেছেন, মওলানা সাহেব সকলের সামনে একথা বলছেন কেন? এই দিন আমি বুঝতে পারলাম মওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই—এ বিশ্বাস আমার ছিল।’ (পৃষ্ঠা-১২৮)

যে পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অবদান ছিল, তারই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান তত্ত্বের মোহভঙ্গ ঘটলো পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই বা তারও আগে। সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগ দুটি দলই হয়তো উঠতি মধ্যবিত্তের সংগঠন। কিন্তু এই দুই অংশের মধ্যবিত্তদের মধ্যেও আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। সংস্কৃতির এবং ভাষাগত পার্থক্য তো দৃশ্যমান।

বঙ্গবন্ধুর মতে বহুকাল ধরে চলা কৃষক আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনই বাঙালিকে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ জাতিগত চেতনায় স্বাভিমান করে তুলেছে। তিনি খুব সুন্দর করে পাকিস্তানের দুটি অংশের পার্থক্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন—‘পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে।’ (পৃষ্ঠা-২৩৯)

তার রাজনৈতিক জীবনে শ্রীহট্টের (সিলেট) গণভোটের প্রচারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রায় ৫০০ কর্মীবাহিনী এবং সাথে মওলানা তর্কবাগীশ, ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়া, ফজলুল হকসহ গণভোট প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, হিন্দু হয়েও পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের এই প্রচারণায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে বঙ্গবন্ধুকে কয়েকটা লঞ্চ দিয়ে প্রচারে সার্বিক সাহায্য দান করেন টাঙ্গাইলের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। (পৃষ্ঠা-৭৬)

পঞ্চাশের দশকের পাকিস্তানে এক ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেস দলের তথ্য দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানে তাদের তখন জীবন্মৃত অবস্থা। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়—“এদের সকলেই হিন্দু, এরা বেশী কিছু বললেই 'রাষ্ট্রদোহী' আখ্যা দেওয়া হত। ফলে এদের মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল।” ( পৃষ্ঠা-১১৪)

বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর অনুরাগ দেখা যায় বইয়ের বিভিন্ন অংশে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা না বললেই নয়। ঘুরেফিরে অনেক স্থানেই এসেছেন তিনি। একটি স্থানে (পৃষ্ঠা-২২৮) রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক জনপ্রিয়তার কথা খুব সুন্দর করে বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে উপস্থাপন করেছেন।

যে পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অবদান ছিল, তারই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান তত্ত্বের মোহভঙ্গ ঘটলো পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই বা তারও আগে। সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগ দুটি দলই হয়তো উঠতি মধ্যবিত্তের সংগঠন। কিন্তু এই দুই অংশের মধ্যবিত্তদের মধ্যেও আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। সংস্কৃতির এবং ভাষাগত পার্থক্য তো দৃশ্যমান।

মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর। যা আজকালকার অনেক নেতাদেরই থাকে না। বর্তমানে অনেকেই কিছু ইংরেজি বুলি শিখে নিজেকে অনেক বড় ভাবতে শুরু করি। কীভাবে মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে পারি এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মাতৃভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন—‘আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ (পৃষ্ঠা-২২৮)

জীবনব্যাপী তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যায়ের সক্রিয় প্রতিবাদের ফলে প্রশাসন প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধুসহ সাতাশজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করলেও, শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় বঙ্গবন্ধুই একমাত্র স্থায়িভাবে বহিষ্কৃত হয়।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার যাদের জন্যে ছাত্রদের বহিষ্কৃত করা হলো, সেই কর্মচারীরাই একমাসের মধ্যে গোপনে যার যার কর্মস্থলে যোগদান করেন। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সর্বসম্মতভাবে ৬১ বছর পরে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে।

বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত ২১ বছরের সময়কালের ধারাবাহিক ইতিহাস, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। মানবতা, সাম্যবাদ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্ভূত রাজনৈতিক দর্শন। বইয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং উদার হৃদয়ের কারণে তিনি যেহেতু অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন তেমনি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছেন যথারীতি।

বিভিন্ন সময়েই তিনি লোক নির্বাচনে প্রতারিত হয়েছেন। আমরা অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জীবনেই দেখি তাদের জীবনের অধিকাংশ লেখাই তারা জেলে বসে লিখেছেন। এক্ষেত্রে নেলসন ম্যান্ডেলা, জহরলাল নেহেরুসহ অনেকেরই নাম উল্লেখ করা যায়। বঙ্গবন্ধু যেমন এই আত্মজীবনীটা জেলে বসে লিখেছেন, একইভাবে সব ধরনের সম্পাদনা করে ভূমিকাটিও তার কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৭ সালে লিখেছেন ঢাকা শেরে বাংলা নগরের সাব জেলে বসে।

এই গ্রন্থে দুর্ভিক্ষ, বিহার এবং কলকাতার দাঙ্গা; পাকিস্তান সৃষ্টির পরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ংকর অপশাসন; বাঙালি এবং বাংলা ভাষা বিরোধী ভূমিকার অভিঘাতে রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন; ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা; যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন; আদমজীতে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, বিভিন্ন ইস্যুতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণসহ বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনায় সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি।

বঙ্গবন্ধুর শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নায়ক নন, একজন সার্থক লেখকও বটে। অসাধারণ প্রাঞ্জলতা, সাবলীলতা তার ভাষায়।বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় কোনো গল্প বা উপন্যাসের বই পড়ছি। নির্মোহ, সর্বজনীন, উদার নিষ্কপট, দৃষ্টিভঙ্গি এই গ্রন্থকে আরও চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়