ছবি : সংগৃহীত

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি আসার পথে ছিনতাই হওয়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে সোমালিয়া উপকূলীয় এলাকায় নেওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, ২৩ নাবিকসহ জিম্মি বাংলাদেশি এই জাহাজটির মুক্তির বিষয়ে জলদস্যুরা এখনো যোগাযোগ করেনি। ফলে দস্যুদের সাথে সমঝোতা করার সময় কেবল বাড়ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা হচ্ছে। জানা গেছে, নাবিকদের বিপদমুক্ত করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কুয়ালালামপুরে পাইরেসি রিপোর্টিং সেন্টার, নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার, যুক্তরাজ্য মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকেএমটিও) এবং এশিয়ায় দস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতি প্রতিরোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় সিঙ্গাপুরে অবস্থিত দপ্তরকে খবর দেওয়া হয়েছে।

জলদস্যুদের কবলে পড়া চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের জাহাজটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড। কবির গ্রুপসহ সরকারি বিভাগ ও সংস্থাগুলোর উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত যেন এই নাবিকদের জীবিত উদ্ধার করা যায়। এর আগে ২০১০ সালে নাবিকসহ একটি বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধারে তিন মাসের বেশি সময় লেগেছিল। 

অতীতের অভিজ্ঞতা এবং এই অঞ্চলের ঝুঁকি বিবেচনায় জাহাজটিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় সুযোগ নিয়েছে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায়, দৃশ্যমান অস্ত্রধারী গার্ড না থাকার সুযোগে প্রায় সাড়ে ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে এসে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই করা সম্ভব হয়েছে।

ইরানি ছোট ফিশিং বোট ব্যবহার করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা ছিনতাইয়ে অংশ নেয়। এমভি আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ভারত মহাসাগরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রুট পাড়ি দিলেও খরচ কমাতে তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি। যার সুযোগ নিয়েছে সোমালিয়ান জলদস্যুরা।

এই ঘটনার পর এখন নতুন নতুন নির্দেশনা দিচ্ছে নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর। বলছে, এখন থেকে লোহিত সাগরের পাশাপাশি ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময়ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হবে। এতদিন কি এই ব্যবস্থা ছিল না? নাকি নির্দেশনা থাকার পরও তা মানা হয়নি?

নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর বলছে, এখন থেকে লোহিত সাগরের পাশাপাশি ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময়ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হবে। এতদিন কি এই ব্যবস্থা ছিল না? নাকি নির্দেশনা থাকার পরও তা মানা হয়নি?

নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী জাহাজ চলাচলে মালিকরা নিয়ম মানলে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে এমন ঘটনা ঘটবে না। তাই এখন থেকে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে চলাচলকারী ৯৭টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজে অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে ভিন্ন সুর শোনাচ্ছেন জাহাজ পরিচালনায় যুক্ত ব্যবসায়ীরা। বলছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গেলে জাহাজ পরিচালনার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। মানুষের জীবন এবং জাহাজের নিরাপত্তা না ভেবে শুধু খরচের কথা ভাবলে এই ধরনের ব্যবসা করা সম্ভব!

নিজস্ব অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াও দস্যুতা মোকাবিলায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হলে কোনো একটি সংস্থা থেকে নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করতে হবে। তখন অতিরিক্ত খরচ হবে। অনেক জাহাজ মালিকই এই খরচ করতে চান না। আর সেই গাফিলতি থেকেই এই জিম্মিদশা। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় ম্যারিটাইম বিশেষজ্ঞরা। দস্যুতা রোধে চিহ্নিত এলাকায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর টহল ছিল না। কম গতিতে চলছিল জাহাজটি, ড্রাফট ছিল বেশি। ঘাটতি ছিল কাঠামোগত নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। সাধারণত জাহাজে কাঁটাতারের সাথে থাকে বিদ্যুতের লাইন।

এছাড়া জাহাজের নিচের দিকে লেজার নিরাপত্তা বা ইলেকট্রিক ফেন্স থাকে যাতে সহজে কেউ জাহাজে উঠে যেতে না পারে। এই জাহাজটিতে সবকিছুর ঘাটতি ছিল। বিশেষ করে লেজার ওয়্যার দিয়ে একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি করার কথা, তাও ছিল না। ফলে জলদস্যুরা যখন এসেছে কোনো বাধা ছাড়াই জাহাজে উঠে গেছে।

দস্যুতা রোধে চিহ্নিত এলাকায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর টহল ছিল না। কম গতিতে চলছিল জাহাজটি, ড্রাফট ছিল বেশি। ঘাটতি ছিল কাঠামোগত নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। সাধারণত জাহাজে কাঁটাতারের সাথে থাকে বিদ্যুতের লাইন।

আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে চলছে বাংলাদেশের ৯৮টি জাহাজ। আরব সাগর, লোহিত সাগর কিংবা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এসব জাহাজ কখনো নোঙর করছে ইউরোপ, কখনো মধ্যপ্রাচ্যে। আগামী দিনগুলোয় এর পরিমাণ আরও বাড়বে, কারণ দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। ২৩ নাবিকসহ জিম্মি হওয়া এমভি আবদুল্লাহর ঘটনা আমাদের জন্য নতুন বার্তা দিচ্ছে। কারণ ভারত মহাসাগরে ফাঁদ পেতে আছে সোমালিয়ার জলদস্যু। লোহিত সাগরে ওত পেতে আছে হুতি বিদ্রোহীরা।

২০১০ সালে জলদস্যুর কবলে পড়া এমভি জাহান মণি জাহাজেরও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সংকট ছিল। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এই চ্যানেল পাড়ি দিতে বাড়তি নিরাপত্তার কথা অনেক আগেই বলে রেখেছিল নৌপথ তদারককারী আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও। বাড়তি নিরাপত্তা নিলে প্রয়োজন হয় বাড়তি কিছু খরচ। এই কারণে নিরাপত্তা কার্যক্রমের সঙ্গে আপস করে জাহাজ চালাচ্ছেন দেশীয় ১৪ গ্রুপের মালিকরা। ৯৮টি জাহাজের মধ্যে ৮টি চালায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।

নাবিকদের জীবন আর নিজের সম্পদের কথা না ভেবে খরচ কমাতে জাহাজ মালিকদের কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়েই পণ্য পরিবহন করছেন এই পথে। এই রুট ব্যবহার না করলেও ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। কিন্তু তাও কোম্পানি মালিকরা করেন না, কারণ আফ্রিকার বিকল্প পথ ব্যবহার করলে জ্বালানি খরচ বেশি পড়ে। সেই সঙ্গে নাবিক ও অন্যান্য কর্মীদের মজুরি দিতে হয় বেশি। বাড়তি গুণতে হয় বীমা খরচও।

কোটি কোটি টাকার মালামাল পরিবহন করছে এই জাহাজগুলো, লাভজনক ব্যবসা করছেন মালিকরা, অথচ নিজের কর্মীদের প্রতি অসহানুভূতিশীল এবং অসংবেদনশীল থেকে ব্যবসা করা কতটা নৈতিক, তা ভাবছেন না তারা।

জাহাজগুলো বাড়তি নিরাপত্তা ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে সাগরে মহাসাগরে। জাহাজ মালিকরা ভাবুন, ভবিষ্যতে নিরাপত্তা খরচ বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকিতে ফেলবেন নিজেরই কর্মীদের? যে নাবিকরা সব বিপদ তুচ্ছ করে সাগর পথ ধরে গন্তব্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্যে পরিশ্রম করে চলেছেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়াটাই হবে সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন