ছবি : সংগৃহীত

মোটাদাগে যদি বলি, আমাদের ব্যাংক খাতে আমি ছয়টা সমস্যা দেখি। প্রথমত, অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ, যার পরিমাণ বিশাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালে ছিল ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, কোনো একটি দেশের অর্থনীতি স্বাস্থ্যের অবস্থা সবল থাকলে মোট ঋণের ২ বা ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে তা ৯ শতাংশ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ঋণ যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে ব্যাংক খাতের আয়ে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থা আরও বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাতে আয়-ব্যয়ের আমরা যে হিসাব করি তার মধ্যে নানান উল্টোপাল্টা উপস্থাপন রয়েছে। আমরা জানি যে, ঋণের মধ্যে সুস্থ ঋণ ও বাজে ঋণ রয়েছে। বাজে ঋণগুলো অনেক সময় সুস্থ ঋণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

বাজে ঋণগুলো যদি যথাযথভাবে হিসাব-নিকাশে উপস্থাপিত হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত চিত্রের বদলে অন্যরকম চিত্র ফুটে উঠবে। বাজে ঋণের বিশালত্ব এবং সুশাসনের অভাব ব্যাংকিং খাতের অন্যতম সমস্যা।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে সব ব্যাংকের ভিত্তিভূমি সবল নয়, সেইখানে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বারা পর্যালোচিত ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো একত্রীভূত করার প্রস্তাবও উঠেছে এবং আগামী এক বছরে ১০টি ব্যাংককে একত্রীভূত করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে।

এর ফলশ্রুতিতে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে আমানত আকর্ষণ করতে শুরু হচ্ছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো কোনো দুর্বল ব্যাংক আমানতের ওপরে সর্বোচ্চ ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বারা পর্যালোচিত ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে।

সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের উচ্চ সুদে আমানত নিলে সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চলতি নিয়ম অনুসারে ন্যূনতম ১৬-১৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে। কয়েকটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত পেতে সর্বোচ্চ ১৭-১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রস্তাব করছে। সেইক্ষেত্রে ঋণ দিতে হবে ২০-২১ শতাংশ সুদে।

এই অসম প্রতিযোগিতার কারণে ঋণের সুদও বেড়ে যাচ্ছে। এতে অসুবিধায় পড়বেন ঋণগ্রহীতারা। তাদের ঋণ ব্যয় বেড়ে যাবে। সমস্যা আরও আছে। উচ্চ সুদের ঋণের অর্থ ফেরত আসবে কি না সেই বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতীতে দেখা গেছে যে, উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে পরে সুদ-আসল দুটোই খোয়া গেছে। অর্থাৎ এভাবে অস্বাভাবিক সুদে আমানত নিলে সেইখানে সুদ তো দূরে থাক, মূল টাকাও ফেরত পাওয়ার আশা হ্রাস পায়।

চতুর্থত, অনেকে বলছেন ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে যে, কোনো তারল্য সংকট নেই। প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। কিন্তু অনপেক্ষ এই পরিমাণ কত তা বড় কথা নয়, কথা হচ্ছে যে এই পরিমাণটি কত দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে।

অনেকের ধারণা, এটি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে এবং ব্যাংক ব্যবস্থা তারল্যের সংকটে ভুগছে। এই অবস্থায় আরও ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে পুরো ব্যাপারটির মধ্যেই ভঙ্গুরতা কাজ করছে। সরকারি খাতে ঋণ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার কথাও নানান জন বলছেন। 

পঞ্চমত, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে জালিয়াতি রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে লাপাত্তা, পুরো ঋণ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছিল কোনো কোনো ব্যাংক থেকে পঞ্চাশটি প্রতিষ্ঠান সাত হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়েছে তারপর তাদের আর কোনো হদিসই মেলেনি।

দেশের বাইরে অর্থপাচারও একটি বড় সমস্যা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ভাষ্যমতে, ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে।

উচ্চ সুদের ঋণের অর্থ ফেরত আসবে কি না সেই বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতীতে দেখা গেছে যে, উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে পরে সুদ-আসল দুটোই খোয়া গেছে।

শেষত বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাসনের বিরাট সমস্যা আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেহেতু অর্থের সঙ্গে জড়িত তাই এখানে উচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। তা নিশ্চিত করা এবং বিধি-নিষেধগুলো ঠিকমতো চালিত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব।

বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, নানান ব্যাংক প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে আনা দরকার কিন্তু আনা যাচ্ছে না।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বা বিবেচনা কাজ করে। এর মাধ্যমে বহু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যাংক স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে সব ব্যাংকের সবল ভিত্তি নেই।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যারা দুর্বল ব্যাংক এবং যারা বিধি নিষেধ মানছে না এমন ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা না নেওয়া এবং তাদের বন্ধ করে না দেওয়া বা নতুন কোনো ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে স্থাপনের অনুমতি দেওয়া এগুলোর কোনোটাই নেই। এটি না হওয়ার কারণে আমরা ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব দেখছি।

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যদি সুশাসন না আসে, এর কাঠামোগত সংস্কার যদি না গ্রহণ করা হয় এবং ব্যাংকিং খাতে গ্রাহক বা সাধারণ মানুষদের আস্থার জায়গাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু অর্থনীতির ভিত দুর্বল হয়ে যাবে।

ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র