‘চিরন্তন মুজিব’ শিরোনামে ১০ দিনব্যাপী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানমালায় আঞ্চলিক ও বিশ্বনেতাদের সরাসরি ও ভার্চুয়াল অংশগ্রহণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাধারণত আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন ব্যতীত এতো নেতৃবৃন্দকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একধরনের ইতিহাস গড়েছে। বাংলাদেশের কূটনীতিতে এই উৎসব আয়োজনের অর্থ কী? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।

‘উৎসবের কূটনীতি’ নামে অভিহিত করে এই অনুষ্ঠান উদযাপন বাংলাদেশের জন্য অবধারিতভাবে কূটনৈতিক সংযোগ-সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা। 

এই উৎসব একদিকে যেমন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিকে শক্তিশালী করেছে, পাশাপাশি বহুপাক্ষিক কূটনীতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশ-ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকসহ যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতির ফলে বাস্তব কিছু অর্জন পরিলক্ষিত হয়। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী একদিকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অর্জনকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভুটান ভারতের চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল যোগাযোগ ব্যবহার করে দু’দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জোর দিয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। দু’দেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ছাড়াও পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। পারস্পরিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে প্রশংসার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, ব্লু ইকোনমি ও বাংলাদেশের অভিবাসীদের স্বার্থে একযোগে কাজ করার কথা বলেছেন। নেপালের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেন। নেপাল ও বাংলাদেশ চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে পর্যটন, সাংস্কৃতিক ও যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সবশেষে, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের ব্যাপক প্রশংসা করেন।

দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক ও যৌথ ঘোষণা এবং বিশ্বের অন্যান্য সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের শুভেচ্ছা বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, সুর্বণজয়ন্তী অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশের কূটনীতির নতুন ধরনের গভীরতা তৈরি করেছে। 

‘উৎসবের কূটনীতি’র মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান অর্জন পরিলক্ষিত হয় যা বাংলাদেশের কূটনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে।

প্রথমত : উৎসব-অনুষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী অবদানকে সমগ্র বিশ্বে আরও পরিচিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত : এই উৎসব বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন সাফল্য, ঐতিহাসিক অর্জন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরার একটি অন্যতম ‘শো-কেসিং’ সুযোগ তৈরি করে। তৃতীয়ত : এই উৎসবমালা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও অর্থবহ ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দুর্লভ সুযোগ তৈরি করেছে। চতুর্থত : ভারতের সঙ্গে আলোচনার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গা সংকট, বাণিজ্য বাধা এবং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

পরিশেষে, এই উৎসবমালা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কূটনীতির এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে ইতিবাচক সুবিধা গ্রহণ করতে পারে।
এই উৎসব আয়োজন এবং বিশ্ব নেতার অংশগ্রহণ একটি উজ্জ্বলতর ও উদীয়মান বাংলাদেশের স্বপ্নকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বিদ্যমান কূটনৈতিক প্রক্রিয়া ও কৌশলগত দিক নির্দেশনার সাফল্য নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক রূপান্তরের এই ঘটনাকে সরকারের নীতি নির্ধারণে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরতে পারলে এবং যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটলে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নতুন যাত্রা সন্দেহাতীতভাবে আরও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে।

ড. দেলোয়ার হোসেন ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ও পরিচালক, দ্যা ইস্ট এশিয়া স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়