কলম্বিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, হাইতি প্রভৃতি দেশের কিশোর গ্যাংগুলো বিখ্যাত। সেগুলো নিয়ে চলচ্চিত্র, গল্প উপন্যাস তো আছেই, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর গবেষণাও আছে। উল্লেখিত দেশগুলোতে বড় বড় ড্রাগ কার্টেলরা মাদক বাণিজ্যের চারণক্ষেত্রগুলোতে বিকল্প সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলে। সেইসব সমাজে নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর অভিযোজনই এরকম হয় যে, পিতামাতাও উঠতি বয়সী সন্তানদের গ্যাং সাব-কালচারের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। তাদের ভাবনাই এরকম হয়ে ওঠে যে বেঁচে থাকতে হলে, টিকে থাকতে হলে সন্তানদের অস্ত্রচালনা থেকে শুরু করে অপরাধের অলিগলি চেনা লাগবেই।

যারা মনে করেন, সন্তানদের নরক জীবন থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেবেন, তারা সহায়-সম্বল, জমি-জমা সবকিছু ছেড়ে অভিবাসী হন পরদেশে। অনেকেই বেরিয়ে আসতে চেয়েও পারেন না। সেইসব সমাজে শিশু-কিশোরেরা অপরাধ জগতের ক্ষুদে ক্রীড়নক হওয়া দিয়ে অপরাধ জগতে পা রাখা শুরু করে বা করতে বাধ্য হয়। মৃত্যুবরণ করে দাগী অপরাধীর তকমা গায়ে নিয়ে। বেশিরভাগ মৃত্যুই অপঘাতমূলক। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ সেইসব দেশের কোনোটির মতোই নয়। তাই কিশোর গ্যাংগুলো যখন বাংলাদেশের জনজীবনকে সন্ত্রস্ত করে বেড়ায়—‘পৃথিবীর কোথায় কিশোর গ্যাং নেই’ বলে বিষয়টিকে হালকা করে দেখা ঠিক নয়। ইউরোপ-আমেরিকায় ইতোমধ্যে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে কিশোর গ্যাং নিয়ে। সেগুলোর অধিকাংশেরই ভাষ্য কৃষিনির্ভর নদী তীরবর্তী সমাজব্যবস্থায় কিশোর গ্যাং জন্ম নেয় না। আরেকটি ভাষ্য এরকম যে, যত বেশি বস্তি গড়ে ওঠার মতো অবস্থা থাকবে, ততো বেশি কিশোর গ্যাং বাড়বে।

দারিদ্র কিশোর গ্যাং-এর অনুষঙ্গ। মধ্যবিত্ত পরিবার-কাঠামোয় কিশোর গ্যাং-এর বিস্তার ঘটে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এইসব অনুসিদ্ধান্তও সঠিক হচ্ছে না। শহর ও মফস্বলে কিশোর গ্যাং বাড়ছে বটে, কিন্তু মোটা দাগে বাংলাদেশ এখনো একটি কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা।

শহর ও মফস্বলে দরিদ্র পরিবার থেকে বা বস্তি থেকে কিশোর গ্যাংগুলোর সদস্য সংখ্যা তেমন বাড়ছে না। বরং বাড়ছে উঠতি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। দরিদ্র পরিবার থেকে বা বস্তি থেকে কিশোর বয়সীরা যোগ দিচ্ছে সাধারণ সদস্য হিসেবে। অর্থাৎ তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে অন্ত্যজ ও অধীনস্থ সহযোগী সদস্য হিসেবে।

 অর্থাৎ তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে অন্ত্যজ ও অধীনস্থ সহযোগী সদস্য হিসেবে। নেতৃত্ব এবং মূলধারার অপরাধ কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ছক কাটছে মধ্যবিত্তের সন্তানরাই।

আগেও বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ ছিল। তবে সেগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত। যেমন ছিঁচকে চুরি, রাহাজানি এবং কিছু সংঘবদ্ধ অপরাধ। গ্যাংকে কিশোর অপরাধের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা একটি বড় ভুল। বাংলাদেশের অপরাধ দমন সংশ্লিষ্টরা দৃশ্যত এই ভুলটিই করছেন। আইনেও কিশোর অপরাধের বিষয় উল্লেখ আছে। সেইসব আইন গ্যাং বিষয়ক গভীর ও জটিল অপরাধের প্রতিবিধান ততোটা করতে পারার কথা নয়। কারণ ‘গ্যাং’ শব্দ মানেই ‘অর্গানাইজড’ ক্রাইম। শুধু সংঘবদ্ধ হলেই গ্যাং হয় না। ‘সুসংবদ্ধ’ হওয়া জরুরি।
গ্যাং-এর অলিখিত সংবিধানের মতো নিয়মকানুন থাকে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো ঠেকাতে নৃশংস প্রতিবিধানের ব্যবস্থা থাকে। নির্দিষ্ট শত্রু থাকে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকে। আরও থাকে প্রশিক্ষণ এবং ক্রমশ অধিকতর হিংস্র হয়ে উঠতে পারার আপ্রাণ প্রয়াস। জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্সি (Juvenile Delinquency) বা কিশোর অপরাধের চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। হয়তো একটি কিশোর বা একদল কিশোর কোনো এক দোকান থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করে দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। দোকানি তাদের শত্রু নয়। চুরির উদ্দেশ্য শুধুই তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানো। ধরা পড়াকেও তারা ভয় পায়। তাদের কোনো নাম নেই। গ্যাং-এর চিহ্ন বা লোগো নেই। গ্যাং-এর নাম, স্মারক চিহ্ন, সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য, ধরন এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোনোটিই চুরির মতো ‘র‍্যান্ডম’ বা তাৎক্ষণিক নয়। ফলে গ্যাং সদস্যরা ভীতিহীন, বেপরোয়া ও হিংস্র হয়। কারণ, তারা জানে একজন আক্রান্ত হলে পুরো গ্যাংই আক্রান্ত হয়েছে ধরা হবে। এই একাত্মবোধ এবং দৃঢ়তম সংহতি তাদের দুর্বিনীত ও দুঃসাহসী করে তোলে।

৩০ মার্চ বেসরকারি একটি টেলিভিশনের টক শো’তে কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেই আলোচনায় আমি ছাড়া অন্য তিনজনই ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের আলাপচারিতা থেকে অনুমান করা গিয়েছিল যে, গ্যাংকে এখনো কিশোর অপরাধের বাইরের কোনো প্রপঞ্চ ভাবা শুরু হয়নি। হয়তো হয়েছে, কিন্তু সেই সময়-সংক্ষেপিত আলোচনায় তুলে আনা যায়নি।

গ্যাং-এর মূল লক্ষ্য আসলে অর্থনৈতিক। মূল কর্মপদ্ধতি আশেপাশের অর্থকরী সকল সূত্রের (যেমন স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য) ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখা। মূল কৌশল ভীতি ও সন্ত্রস্ততা জিইয়ে রাখা। মূল রক্ষাকবচ আড়ালের কেউ—গডফাদার, বড় ভাই, রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী ক্ষমতাধর কেউ। মূল শক্তি নেটওয়ার্ক। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কোনো কোনো নেটওয়ার্কের অংশ...

আলোচকদের একজন বলেছিলেন, বয়সটা হিরোগিরির বয়স। তার বক্তব্য সত্য। তবে এটি গ্যাং-চরিত্র বুঝতে সহায়ক নয়। নিরীহ ঘরকুনো পড়ুয়া নিরপরাধ কিশোরের মাঝেও হরমোনজনিত কারণে হিরোগিরির ভাবটি তৈরি হয়। কিন্তু তাদের বেশিরভাগেরই হিরোগিরি-মনোভাবটি অপরাধ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে না। বরং অনেকে গ্যাং-আচরণকে উল্টো ভিলেন-পরিচিতি দেয়। নিজেদের গ্যাং বিরোধী নায়কের রূপে দেখতে পছন্দ করে। এই বয়সে ফ্যান্টাসি থাকে। নাটুকেপনা থাকে। আলোচনায় এইসব তথ্যও উঠে এসেছে। কিন্তু, গ্যাং বরং প্রথম যে কাজটি করে, তা হচ্ছে সদস্যদের ফ্যান্টাসির কবর খোঁড়া।

কয়েকদিন আগের খবর—দুই গ্যাংয়ের বিবাদ মেটাতে সালিশ বসেছিল। সালিশেই এক পক্ষ ছুরিকাঘাতে প্রতিপক্ষের তিনজনকে খুন করল। স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা শতভাগ বিনষ্ট করা না গেলে এই রকম আচরণ সম্ভব হয় না। ফ্যান্টাসি সংবেদনশীলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দূরকল্পনা বা ফ্যান্টাসি বরং হিংস্র হতে বাধা দেয়।

গ্যাং-এর মূল লক্ষ্য আসলে অর্থনৈতিক। মূল কর্মপদ্ধতি আশেপাশের অর্থকরী সকল সূত্রের (যেমন স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য) ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখা। মূল কৌশল ভীতি ও সন্ত্রস্ততা জিইয়ে রাখা। মূল রক্ষাকবচ আড়ালের কেউ—গডফাদার, বড় ভাই, রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী ক্ষমতাধর কেউ। মূল শক্তি নেটওয়ার্ক। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কোনো কোনো নেটওয়ার্কের অংশ—এ রকম অভিযোগও আছে। সেই টক শো’তেই উল্লেখ করা হয়েছে মিডিয়াটির একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের হাতে পুলিশি সম্পৃক্ততার তথ্যও রয়েছে। এই পেছনের শক্তিই মূলত গ্যাং উৎপাদনের বীজতলা।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের অনুধাবন এই যে, দুর্বৃত্ত রাজনীতিই কিশোর গ্যাং বেড়ে ওঠার বীজতলা। খুঁজলেই দেখা যাবে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন কোনো একজন ক্ষমতাধর স্থানীয় রাজনৈতিক পাণ্ডা যাকে ঠাণ্ডা করার মতো কোনো কলকব্জা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবিহিনীর হাতে নেই।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন ।। অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়