বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির তাণ্ডব চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ব্রাজিল, ইরান, মেক্সিকো সহ বিভিন্ন দেশের পর এখন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে প্রবলভাবে দৃশ্যমান। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। চলতি এপ্রিলে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় গুণেরও বেশি। 

দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এপ্রিলে এখনো পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৪ হাজার ৬০০ রোগী। তাদের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ১৭ হাজার ৩৩৮ জন মারা গেছেন গত সাত দিনে। (ঢাকা পোস্ট, ২৭ এপ্রিল ২০২১) হাসপাতালগুলোতে ক্রমেই বাড়ছে রোগীর চাপ, বেড সংকট, অক্সিজেন সংকট সহ রয়েছে বিভিন্ন রকমের সীমাবদ্ধতা। এক কথায়, এই সংকট মোকাবিলায় ভারতের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী।

অথচ গত বছর সময়োপযোগী ও দ্রুত পদক্ষেপে প্রথম ঢেউ যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল দেশটি। সে সময় সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সমগ্র দেশজুড়ে তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয় যা মে ২০২০ পর্যন্ত কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে শুধুমাত্র বেশি আক্রান্ত স্থানসমূহে জুন মাস পর্যন্ত লকডাউন বলবৎ রাখা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যবস্থাপনাটি সে সময় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো, ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিল করা। এরমধ্যেই গত সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ সংক্রমণ রেকর্ড হয় এবং এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসে। ভারতের প্রথম ঢেউ মোকাবিলার যে তথ্যগুলোর অবতারণা এখানে করা হল, তা এ কারণে যে, ভারত এবং বাংলাদেশের প্রথম ঢেউয়ের চিত্র প্রায় একই রকম। আর বাংলাদেশ সরকারও সে সময় লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সহ বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে সংক্রমণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। 

বিজ্ঞানীরা ভারতের বিভিন্ন আক্রান্ত রাজ্যের ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে ‘ডাবল-মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্ট’ এর সন্ধান পান যা কিনা অনেক বেশি সংক্রামক এবং অত্যন্ত তীব্র। ভাইরাল মিউটেশনের চেয়েও উদ্বেগজনক রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যেখানে ‘ট্রিপল-মিউটেটেউ ভ্যারিয়েন্ট’ এর কথা উল্লেখ করা হয়, যা পশ্চিমবঙ্গে প্রাপ্ত নমুনা থেকে পাওয়া যায়। এটাকে ‘বেঙ্গল স্ট্রেইন’ নামেও অভিহিত করা হয়।

ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত আসতে শুরু করে এ বছর মার্চে। কিন্তু তখন জনসাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানতে ব্যাপক উদাসীনতা প্রদর্শন করে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল সহ সবকিছুই খুলে দেওয়া হয়। আর বেড়ে যায় বিভিন্ন জায়গায় জনসমাগম। সম্প্রতি কুম্ভমেলার নামে লক্ষ মানুষের জমায়েত হয় যা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। গণমাধ্যমে জানা যায়, ঐ কুম্ভমেলা থেকেই প্রায় কয়েক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। অদ্যাবধি ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা দেশটির জন্য চরম সংকটময় পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়।

বিজ্ঞানীরা ভারতের বিভিন্ন আক্রান্ত রাজ্যের ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে ‘ডাবল-মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্ট’ এর সন্ধান পান যা কিনা অনেক বেশি সংক্রামক এবং অত্যন্ত তীব্র। ভাইরাল মিউটেশনের চেয়েও উদ্বেগজনক রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যেখানে ‘ট্রিপল-মিউটেটেউ ভ্যারিয়েন্ট’ এর কথা উল্লেখ করা হয় যা পশ্চিমবঙ্গে থেকে প্রাপ্ত নমুনা থেকে পাওয়া যায়। এটাকে ‘বেঙ্গল স্ট্রেইন’ নামেও অভিহিত করা হয়। এই বেঙ্গল স্ট্রেইন এ ‘E484K’ মিউটেশনের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে সংক্রমিত ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য। এই ‘E484K’ ভ্যারিয়েন্ট মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। ফলে পূর্বে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিও এই স্ট্রেইনে নতুনভাবে আক্রান্ত হতে পারে। এটির সংক্রমণ ও রোগের তীব্রতা বাড়ানোর ক্ষমতা ‘ডাবল-মিউটেটেউ ভ্যারিয়েন্ট’ এর চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত ভারতের মতো ততটা শক্তিশালী না হলেও যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও লকডাউন পুরোপুরি শিথিল হওয়ার পরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং আগত যাত্রীদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ঘোষণা দিয়েছে। 

অর্থনৈতিকভাবে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের চাইতে অনেক এগিয়ে। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক উন্নত। সেই ভারতের অবস্থা এখন পর্যুদস্ত, করোনার এই আঘাত মোকাবিলায় তারা অসফল। বাংলাদেশেও যখন আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজারের উপরে ছিল তখন কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল।

নিঃসন্দেহে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। করোনা মহামারিতে চলমান দ্বিতীয় ঢেউ এবং সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য দ্রুত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী অধিক আক্রান্ত এলাকাগুলোতে কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থা করতে হবে। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।

আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেন প্রথম ওষুধ। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে আমাদের অতি প্রয়োজনীয় স্নায়ুকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে রোগী দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এজন্য আমাদের অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ,  রোগীর চাপ যদি ভবিষ্যতে আরও বাড়ে তবে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সংকট দেখা দিতে পারে। ভারতে অক্সিজেনের সংকটে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও সাময়িকভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা এসেছে, যা ভালো দিক।

ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ অক্সিজেন সহ অন্যান্য সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে আমরাও তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই। সেই সাথে ভারতের অবস্থা দেখে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কারণ অর্থনৈতিকভাবে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের চাইতে অনেক এগিয়ে। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক উন্নত। সেই ভারতের অবস্থা এখন পর্যুদস্ত, করোনার এই আঘাত মোকাবিলায় তারা অসফল। বাংলাদেশেও যখন আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজারের উপরে ছিল তখন কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। সাধারণ বেড, অক্সিজেন ও আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছিল। কাজেই ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। নতুবা অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের এই ধরনের উদ্বেগের কারণ ভারতের সংক্রমণ চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সংক্রমণ চিত্রের হুবহু সাদৃশ্য।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়