আমরা যখন মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস আলোচনা করি, যখন বলি আমাদের অবিনাশী মুক্তিযুদ্ধের কথা, তখন অবশ্যম্ভাবী আলোচিত হয় আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসও। মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের যে দীর্ঘপথ ধরে বাঙালি তার কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, তার প্রতিটি পরতে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অবদান রয়েছে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ সেই অর্থে আমাদের ইতিহাসের এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে যে ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছিল, ১৯৪৭ সালে তাতে তারা সফল হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানি, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। আর তাদের বাধ্য করার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আজও আমাদের ইতিহাসের এক গর্বিত অধ্যায়। সেই আন্দোলনের এক অনন্য নেতৃত্বে ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং ১৯১৩ সালেই নোবেল পুরস্কার পান কবিগুরু। রাজপথের রবীন্দ্রনাথ তখন বিশ্বমঞ্চে।

কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই ষড়যন্ত্র ঠেকানো গেল না। এর কারণটি খুঁজে বের করলেই আমরা বুঝতে পারি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি রাজনৈতিক সংগ্রামে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। দেশভাগের আগে ব্রিটিশ সরকার ক্রমাগত জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে এবং তার আগে তারা নস্যাৎ করে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দেশভাগের পর বাঙালিরা সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আবারও আঁকড়ে ধরে, কারণ ততদিনে তারা বুঝে গেছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারা শুকিয়ে গেলে রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটে একটি জাতির।

বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষাটের দশকের কিছু আগে। ‘মুক্তধারা’ নামের এই সংগঠনটি যদিও পরবর্তীতে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেনি আইয়ুব খানের ক্রমাগত নিপীড়ন নির্যাতনের ফলে...

ব্রিটিশদের মতোই পাকিস্তান সরকারও রাজনৈতিক আক্রমণের আগে সাংস্কৃতিক আক্রমণ করেছে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের দুর্বার প্রেক্ষাপট তার প্রমাণ। ১৯৫২ সালে বুকের রক্তে রচিত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং এই মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দেশভাগ পরবর্তী বাংলায় সূচিত হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন পাশাপাশি হেঁটেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস এ কারণেই অন্য যেকোনো আন্দোলনের চেয়ে পৃথক। কেননা, এই সংগ্রামে সাংস্কৃতিক গতিধারার সঙ্গেই রাজনৈতিক গতিধারা রচিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষাটের দশকের কিছু আগে। ‘মুক্তধারা’ নামের এই সংগঠনটি যদিও পরবর্তীতে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেনি আইয়ুব খানের ক্রমাগত নিপীড়ন নির্যাতনের ফলে, কিন্তু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সাংগঠনিক রাজনৈতিক কার্যক্রমের সূচনা ঘটেছিল এর মধ্য দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ছায়ানট’. ‘ক্রান্তি’, ‘সৃজনী’, ‘উদীচী’ এই সংগঠনগুলোর জন্ম হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের যাত্রাও শুরু হয়। ‘পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা, সেই প্রচেষ্টারই ফসল। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে পেছনের দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করা হয়েছিল, তেমনি ধ্বংস করা হয়েছে সাংস্কৃতিক বোধ। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় মদদে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক অপসংস্কৃতি। পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটলেও, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলো সাম্প্রদায়িক দমননীতির যে বলয় তৈরি করেছিল, তা আর ভাঙা গেল কই?

অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার মায়ের সঙ্গে একটি ছবি আপলোড করেছে। আপলোড করা সেই ছবিতে কুৎসিত বর্বরোচিত মন্তব্য শুরু করে একশ্রেণির ধর্মান্ধগোষ্ঠী। এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কীভাবে জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব গ্রাস করে নিয়েছে তা এইখানেই স্পষ্ট...

মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী অপশক্তির উত্থান; যশোর-নেত্রকোণা উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা; ছায়ানটের বর্ষবরণে বোমা হামলা থেকে শুরু করে একের পর এক সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বাঙালির সাংস্কৃতিক অক্ষবিন্দুটিরই বদল ঘটিয়ে ফেলেছে। তারই উন্মাদ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বর্তমানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কী বর্বরভাবে তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চালায় জনসাধারণের মনস্তত্ত্বে।

বিশ্ব মা দিবসে অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার মায়ের সঙ্গে একটি ছবি আপলোড করেছে। আপলোড করা সেই ছবিতে কুৎসিত বর্বরোচিত মন্তব্য শুরু করে একশ্রেণির ধর্মান্ধগোষ্ঠী। এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কীভাবে জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব গ্রাস করে নিয়েছে তা এইখানেই স্পষ্ট। কীভাবে তারা মনন ও বোধকে ধ্বংস করে দিয়েছে তা এইখানে পরিস্ফুট।

প্রশ্ন হলো, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? আমার উত্তর, আবারও একাত্তরের মতোই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যূথবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ কথা মানতে দ্বিধা নেই যে, আজ আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। এ দোষ সংস্কৃতির নয়, বরং সাংস্কৃতিককর্মীদের।
একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমি নিজেদের সমালোচনাটিই করতে চাই সর্বাগ্রে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন আজ কেবল যেন পরিবেশনাতেই আটকে আছে। আমরা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। এই দায় আমাদের।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই কাজটি করার জন্য আমাদের নগরকেন্দ্রিক চিন্তা পরিহার করতে হবে। আর রাজনৈতিক আন্দোলনের কথাটি যদি বলি, তবে বলতে হবে, আইনের শাসন। এই যে অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে অসভ্যতা করা হলো, তার বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। আমরা জানি কাউন্টার টেরোরিজমের মাধ্যমে এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নীরবতা আমাদের চিন্তিত করে তুলে।

এখন সময় এসেছে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যূথবদ্ধ হয়ে আন্দোলন পরিচালিত করার। তবেই আমাদের বিজয় অর্জন সম্ভব। কেবল রাজনৈতিক আন্দোলন হয়তো রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে পারে কিন্তু জনমনস্তত্ত্বের বদল ঘটাতে হলে চাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী