প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি এবং অবৈধভাবে তথ্য পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে দুটি ভিন্ন আইনে। একটি আমাদের দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং আরেকটি অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের (The Official Secrets Act, 1923) ৩ ও ৫ ধারায়।

অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের প্রবর্তন আমাদের এই অঞ্চলে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে হলেও এই আইনের অধীনে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কেউ অভিযুক্ত বা শাস্তি পেয়েছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। এর প্রয়োগ বাংলাদেশে যেহেতু আগে হয়নি ফলে এই আইনটি নিয়েও জনমানুষের মধ্যে কৌতূহলের সীমা নেই।

একজন সাংবাদিক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে এই ধরনের আইন কিংবা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন এটা নানাবিধ কারণেই মেনে নেওয়া কষ্টের। রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে কী হয়েছে এবং পুরো ঘটনা কী, এটা বোধকরি এখন সবাই জানেন। তাকে যে আইনে বিশেষ করে অফিসিয়াল গোপনীয়তার আইনে অভিযুক্ত করা হলো (৩ ও ৫ ধারা) সেই আইনটি আমাদের একটু দেখা দরকার।

অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের প্রবর্তন আমাদের এই অঞ্চলে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে হলেও এই আইনের অধীনে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে কেউ অভিযুক্ত বা শাস্তি পেয়েছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। এর প্রয়োগ বাংলাদেশে যেহেতু আগে হয়নি ফলে এই আইনটি নিয়েও জনমানুষের মধ্যে কৌতূহলের সীমা নেই।

এই আইনের ৩(১)(ক) উপধারায় নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশের কথা স্পষ্ট বলা রয়েছে এবং এই অংশের শিরোনামই বলছে- Penalties for spying বা গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তি। এই আইনের প্রয়োগ কার বিরুদ্ধে হবে এটি নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হলেও, এটা আইনেই স্পষ্ট যে, আইনের উক্ত ধারাতে (ধারা ৩) যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে এই আইনের মূল ভিত্তিমূল তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে ছিল গুপ্তচরবৃত্তি রোধের উপায় হিসেবে। সেক্ষেত্রে আইনের ‘পারপাসিভ এপ্রোচ’ বা মূল উদ্দেশ্য ধরে বিবেচনায় আনলে বলতে হবে এই আইনটির কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা রুদ্ধ হলে সেটা আসলে আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।

আমরা যদি আলোচ্য আইনের ৩ ধারাটিকে আরেকটু পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যায় যে সেখানে ‘in the vicinity of, or enters, any prohibited place’ বা নিষিদ্ধ এলাকাতে গমন বা বিচরণ বাক্যটি রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে রোজিনা ইসলাম যেখানে গিয়েছেন সেটা আসলে নিষিদ্ধ এলাকা ছিল কি না। আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে যতদূর জেনেছি, তিনি ‘সচিবালয় বিটে’র সাংবাদিক ছিলেন, তার যথাযথ পাস নেওয়া ছিল এবং তিনি অনুমতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেই একান্ত সচিবের কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। যদিও এই সংক্রান্ত প্রত্যেকটি দাবির ক্ষেত্রে প্রমাণ প্রয়োজন হবে এবং আদালতেই তা নিরূপিত হবে কিন্তু ‘প্রাইমা ফেসি’ বা আপাত দৃষ্টিতে এটি বলা যেতে পারে যে, রোজিনা ইসলাম কোনো নিষিদ্ধ স্থানে যাননি যেটিকে তার এখতিয়ার বহির্ভূত স্থান বলা যেতে পারে। ফলে এই উক্ত ধারাটি শুরুতেই আসলে ব্যর্থ হয় বলে আমার ধারণা।

একইভাবে এই আইনের ৫ ধারায় যা বলা রয়েছে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, ‘Wrongful communication, etc. of information’ বা তথ্যাদি নথিপত্রের ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ যোগাযোগ। এই ধারায় আসলে যে অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা মূলত স্পষ্টভাবে সূচিত করে সরকারি কর্মচারীকে কিংবা সরকারের এমন কোনো ব্যক্তি যার কাছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথির পাসওয়ার্ড, কোড, স্কেচ প্ল্যান ইত্যাদি থাকে এবং সেটা অনুমতি ব্যতিরেকে কারো সাথে শেয়ার কিংবা কাউকে এটি দিয়ে দিলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

আইনটির এই সুনির্দিষ্ট ধারার দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই ধারাটি আসলে সাংবাদিক রোজিনার উপরেই বর্তায় না, মানে এই সুনির্দিষ্ট ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। এই ধারার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ধারায় আসলে ব্যক্তিকে এমন হতে হবে যার কাছে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে অফিস কোড, পাসওয়ার্ড, নথি ইত্যাদির এবং যার উপর আস্থা রাখা হয়েছে। তেমন কোনো ব্যক্তি যদি এই জাতীয় নথি শত্রু পক্ষকে অনুমতি ব্যতিরেকে ‘অথরাইজড’ নয় এমন কাউকে দেন, শেয়ার করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ৫ ধারার ‘ডি’ উপধারা মতে আসলে এই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একান্ত সচিব থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে সেটি কীভাবে?

উক্ত উপধারায় বলা হয়েছে, যার কাছে এমন গুরুত্বপূর্ণ নথি, কোড, পাসওয়ার্ড ইত্যাদির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিন্তু তিনি সেটিকে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারেননি তথা উক্ত নথির ক্ষেত্রে যে গোপনীয়তা তার নেওয়ার কথা ছিল, সেটা তিনি রাখেননি, সেই ক্ষেত্রে উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মকর্তাগণই দোষী সাব্যস্ত হবেন। আইন বলছে—

(d) fails to take reasonable care of, or so conducts himself as to endanger the safety of, the sketch, plan, model, article, note, document, secret official code or password or information; আইনি অনুবাদ করলে মূলকথা দাঁড়ায়, যার কাছে এই ধরনের নথির সর্বোচ্চ দায়িত্ব অর্পিত থাকবে, তাকেই এই নথির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

পুরো ঘটনার প্রেক্ষিতে এটি এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট যে, সাংবাদিক রোজিনা কোনো গুপ্তচর নন। তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন। কোনো গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আসলে তিনি সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছেন, এমনটা এখনো পর্যন্ত প্রমাণহীন।

ফলে এই যে বলা হচ্ছে রোজিনা ইসলাম একান্ত সচিবের ডেস্কে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি করেছেন, প্রশ্ন আসবে সেই নথির দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা কি সেই নথির পূর্ণ ‘টেক-কেয়ার’ বা নিরাপত্তা আদৌ নিতে পেরেছিলেন?

একটা ডেস্কে এত গুরুত্বপূর্ণ নথি ফেলে রাখা কি আইনে বলা ‘রিজেনেবল কেয়ার’ শব্দদ্বয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই অবহেলার জন্যই কিন্তু উল্টো এই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তা-ব্যক্তিরাই ফেঁসে যাবেন উক্ত আইনের ৫(ডি) উপধারা মোতাবেক।

পুরো ঘটনার প্রেক্ষিতে এটি এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট যে, সাংবাদিক রোজিনা কোনো গুপ্তচর নন। তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন। কোনো গুপ্তচর বৃত্তির জন্য আসলে তিনি সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছেন, এমনটা এখনো পর্যন্ত প্রমাণহীন। উল্টো ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’ এর ৫ ধারার ১ থেকে ৬ উপধারা মতে, রোজিনা ইসলামকে যারা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথও রুদ্ধ। ফলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের ৩ ধারার যে নিষিদ্ধ স্থানের কথা বলা হচ্ছে, সেই সংজ্ঞায় রোজিনা ইসলাম পড়েন না।

আবার ৫ ধারা তার উপরেই বর্তায় না এবং তাকে যারা নানাবিধ তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটা কঠিন, উপরে উল্লেখিত আইনের কারণে। সব মিলিয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামই এগিয়ে রয়েছেন এই মামলায় কিংবা এই আমলা বনাম সাংবাদিক দ্বৈরথে।

ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার ।। আইনজীবী ও গবেষক