আজ ২৮ মে, জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করে আসছে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সকল নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণই হলো নিরাপদ মাতৃত্ব।

নারী মাত্রই মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে চান। মাতৃত্বের মধ্য দিয়েই নারী জীবনের পূর্ণতা লাভ করেন। এ সময় সব মায়েরই স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়। থাকে জীবনের ঝুঁকিও।  তাই গর্ভকালীন সময় টিটি টিকা দেওয়া, ওজন মাপা, স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া, রক্তস্বল্পতা বা শরীরে রক্ত কম কি না তা পরীক্ষা করা, রক্তচাপ পরিমাপ করা, পা অথবা মুখ ফুলে গেলে পানি আছে কি না দেখা, শারীরিক অন্য কোনো অসুবিধা আছে কি না তা পরীক্ষা করা দরকার।

স্বামীসহ পরিবারের সবার সাবধানতা ও আন্তরিক সহযোগিতায় এ ধরনের ঝুঁকি থেকে একজন মা রক্ষা পেতে পারেন। এ জন্য মায়ের পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়।

যেমন (১) সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কিছু অর্থ জমা রাখতে হয়। (২) তাকে কোনো হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে সে সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নিয়ে রাখতে হবে। (৩) প্রয়োজনে রক্ত দিতে পারবেন এমন কাউকে আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে।

সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের প্রতি ত্রিশ জনের মধ্যে তিনজন করোনা আক্রান্ত শিশুর জন্ম দিচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এবছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, করোনাকালীন সময়ে আমরা ঘরে থাকি এবং মা ও শিশুকে নিরাপদে রাখি। করোনার সংক্রমণ ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। এখন গড়ে প্রতিদিন ২০০০-৩০০০ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।

গর্ভবতীরাও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। গর্ভাবস্থায় শরীর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে, করোনার জন্য যা আরও বৃদ্ধি পায়। দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভ চলছে, যার কারণে অন্তঃসত্ত্বারাও এখন চরম ঝুঁকির সম্মুখীন। করোনা স্পেশালাইজড হাসপাতালসহ সবধরনের হাসপাতালগুলো রোগীর ভিড় আর আহাজারিতে ভারাক্রান্ত। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের প্রতি ত্রিশ জনের মধ্যে তিনজন করোনা আক্রান্ত শিশুর জন্ম দিচ্ছেন।

সচেতনতার অভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনা প্রতিরোধে নিয়মাবলী, অর্থাৎ মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, স্যানিটাইজার ও সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, এসব বিষয় বাকি সবার মতো অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

গর্ভাবস্থায় প্রথম তিনমাস সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই তিনমাস যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাইরে চলাচল যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। বাইরে গেলে সতর্কতা মেনে মাস্ক পরে যেতে হবে। মুখটা ধরা ছোঁয়া এড়িয়ে চলতে হবে। ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।

করোনা আক্রান্ত হলেও সাধারণত দেখা যায় প্রথম ট্রাইমেস্টারে বাড়িতে যথাযথ বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া ও শরীরচর্চা করলে সেরে যায় তবে নিয়মিত মনিটরিং এ রাখতে হবে এবং জরুরি অবস্থায় বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। করোনা প্রতিরোধে মা ও শিশুকে ভিড় এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনু্যায়ী ভিটামিন সি, ডি ও জিংক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।

ডায়াবেটিস, হাঁপানি বা শ্বাস প্রশ্বাসজনিত জটিলতা যাদের আছে, সেসব অন্তঃসত্ত্বা নারীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হন। এসব ক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর পানি কমে যাওয়া, অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়াসহ আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই জটিলতা এড়াতে এবং দ্রুত মোকাবিলা করতে সবসময় তাকে মনিটরিং এ রাখতে হবে। সম্ভব হলে প্রতি ছয় ঘণ্টা পরপর অক্সিজেন লেভেল চেক করতে হবে এবং স্যাচুরেশন ৯৪ এর কম হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

গর্ভাবস্থায় প্রথম তিনমাস সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই তিনমাস যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাইরে চলাচল যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। বাইরে গেলে সতর্কতা মেনে মাস্ক পরে যেতে হবে।

এছাড়া দেখা গিয়েছে করোনার নতুন স্ট্রেইনটি পিসিআর টেস্টে অনেক সময় ধরা পড়ছে না। সেক্ষেত্রে উপসর্গ মিলে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা উচিত। তবে সচরাচর দেখা যায় করোনা থাকলেও প্রসবে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

মা করোনা আক্রান্ত হলে জন্মের পরেও বাচ্চার প্রতি অধিক যত্নশীল ও সতর্ক হতে হবে। স্তন্যদান ও অন্যান্য সময় মাস্ক পরে শিশুর কাছে যাওয়া উচিত। হাঁচি ও কাশি যাতে শিশুর স্পর্শ না পায়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, স্তন্যপানে শিশুর কোনো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বরং মায়ের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং করোনা প্রতিরোধে সহায়ক হবে। তবে সম্ভব হলে ব্রেস্ট পাম্প ব্যবহার করা উচিত এবং সেই ব্রেস্ট পাম্প ভালো করে ধুয়ে মুছে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হলো, মা যদি করোনা আক্রান্ত হয়, তাহলে ব্রেস্ট পাম্প করে সেটা বোতলে দেন এবং সেটা অন্য কাউকে দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ান।

করোনা খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়াতে পারে, তাই শুধু গর্ভবতী মা নয়, পরিবারের সকল সদস্যকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে কারণ করোনা পরিবারের একজনের হলে বাকিদের মধ্যে ছড়ানোর প্রবল সম্ভাবনা থাকে। সর্বোপরি, শুধু মা ও শিশু না, সকলকেই করোনার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং সতর্কতা ও দূরত্ব বজায় রেখে কাজকর্ম করতে হবে। গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী বলা যায়, গর্ভাবস্থায় করোনার টিকা দিতে তেমন বাধা নেই। কেউ যদি টিকা নেন তাহলে পরবর্তী দুই-তিন মাস গর্ভধারণ প্রতিরোধক ব্যবহার করা উচিত।

ডা. সংযুক্তা সাহা ।। অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, উত্তরা, ঢাকা