সমঅধিকার নিশ্চিত হবে কবে?
আমি ৭-৮ বছর ধরে এই নারী দিবসের ক্যাম্পেইন, মেসেজিং, ডিজাইন নিয়ে কাজ করি। প্রতিবারই যখন বদলে দেওয়ার বার্তা, নারীর প্রতি কৃতজ্ঞতার বার্তা নিয়ে কাজ করি, মনে একটা ক্ষীণ আশা জাগে।
মনে হয়, এত এত আন্তর্জাতিক সংস্থা, নারী অধিকার নিয়ে নেটওয়ার্ক বা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে, ধীরে ধীরে আমরা মনে হয় ভালোর দিকে যাবো। সমতার দিকে রাতারাতি পৌঁছাতে না পারলেও নারীদের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, আর নিরাপত্তা বাড়বে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি, প্রতি বছর ক্যাম্পেইন যত সুন্দর হচ্ছে, নারীদের আমরা ততই পিছিয়ে দিচ্ছি। সব বয়সের নারীদের নিরাপত্তা হচ্ছে আরও প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু কেন? কীভাবে?
বিজ্ঞাপন
প্রথমেই আমি বুঝতে চেষ্টা করি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। পুরুষতন্ত্র সর্বতোভাবে নারীর শোষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখে এবং ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী করে। কীভাবে?
পুরুষতন্ত্র একজন নারীকে তার রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে উঠতে দেয় না। রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবে একজন নারীর যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সামাজিক অধিকার ভোগ করার কথা, সেগুলো নিয়ে পুরুষতন্ত্র ভীত হয়ে পরে।
বিজ্ঞাপন
পুরুষতন্ত্র অত্যন্ত অশুভ একটি শক্তি হলেও দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহকরাই একে শক্তিশালী করেছে।
কোনো নারী যখন এসব অধিকারের দাবি জানাবে, তখন একজন মানুষের পুরুষতান্ত্রিক মগজের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে নির্দেশ দেবে দমনের। সেই দমনের উপায়গুলো হবে গালি দেওয়া, সুযোগ কেড়ে নেওয়া, ডিহিউম্যানাইজ করা, শারীরিক আঘাত, যৌন নির্যাতন করা এবং হত্যা করা।
শারীরিক আঘাত এবং যৌন নির্যাতন যে শুধু রাগ থেকে কিংবা যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য পুরুষেরা করে থাকে তা নয়। এর পেছনে রয়েছে শোষণের রাজনীতি। যখন পুরুষ যৌন নির্যাতন করে, তখন একটা অথরিটি স্টেটমেন্ট দিতে চায়, ওই ভুক্তভোগী নারী, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে এবং স্টেটমেন্টকে আবার দিনের পর দিন টিকিয়ে রাখে পুরুষতন্ত্র চালিত ও নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র, সমাজ, ও ধর্ম চর্চা।
নারীকে নারী হিসেবে না দেখে একজন নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত, বিচার, উপদেশ ও চর্চা চালিত হয়ে পুরুষতান্ত্রিক মগজ দিয়ে। সুতরাং একজন যৌন হয়রানিকারী তিন ক্ষেত্র থেকেই এক ধরনের শক্তিশালী দায়মুক্তি ভোগ করে, ফলে বারবার টিকে যায় পুরুষতন্ত্র এবং আরও শক্তিশালী হয়।
আরও পড়ুন
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চর্চা, সামাজিক বিচার, সালিশ, আইন-আদালত, মোরাল পুলিশ, পরিবার এমনকি দেশের নারীরাও ব্যাপকভাবে একেক লেভেলের পুরুষতন্ত্রে আক্রান্ত।
আমার নিজের মগজের পুরুষতন্ত্র দমন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ পার হয়ে গেছে। এমনকি এখন যে আমার মগজ তাও পুরুষতন্ত্রমুক্ত না। আমি এই সমাজেই বেড়ে ওঠা মানুষ। তবে প্রতিদিন চেষ্টা করি, নিজের সাথে যুদ্ধ করি, যেন এই পুরুষতন্ত্র আমার মগজে একটুও স্থান না পায়। আমার কর্মে কখনো প্রতিফলিত না হয়।
কেন পরিবর্তন আসা কঠিন?
পুরুষতন্ত্রকে গলা টিপে মারার ক্ষমতা যাদের কাছে আছে এবং যাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় তারা হলেন রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় যারা এই রাষ্ট্রযন্ত্র আর প্রশাসনিক ক্ষমতার দায়িত্ব নেয়, তারা নিজেরা তো পুরুষতান্ত্রিক বটেই এবং তাদের এই দায়িত্ব নিতে যে রাজনীতিটা করে আসতে হয়, তা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতি।
নারীর নিরাপত্তা আর অধিকার নিশ্চিত করলে তারা হয়তো এই রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর সুযোগবঞ্চিত হবে। এই ঝুঁকি কেউই নিতে চায় না। মাঝে মাঝে ছোটখাটো উদ্যোগ নিলেও তারা বাধার মুখে পড়ে। এই বিষয়ে আলাপ অধিকাংশ মানুষের ভালো লাগে না। তাদের মনে হয় এই আলাপের উদ্দেশ্য পুরুষের অধিকার, সুযোগ এবং অবাধে অন্যায় করার যে দায়মুক্তি তা কেড়ে নেওয়া। পাঠ্যবইতে আপনি সমতার কথা, পুরুষতন্ত্রের কথা অন্তর্ভুক্ত করে দেখুন, বাধা আসবে।
এই ধরনের আলাপ সবাই শেষ করে এভাবে—
‘আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, বিচারবিভাগ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, সমাজ সবাইকে এগিয়ে এসে একসাথে কাজ করতে হবে নারী অধিকার নিশ্চিতে।’
আমার কাছে এই অংশটুকু বা ধরনের আলাপ অনেক বছর ধরে চলে আসা টেমপ্লেট মনে হয়। উপসংহার টেমপ্লেট। অনেক এগিয়ে আসা দেখলাম।
এখন শুধু আশায় আছি নারীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার। আমরা খুব বেশি দূরে না, যেদিন ঘর থেকে সব নারী বেরিয়ে আসবে তার অধিকার চাইতে। নারীদের এত গৃহবন্দি আর মূর্খ করে রাখার যে চেষ্টা, এই চেষ্টা একদিন টিকবে না। একদিন নারীরা ঘর থেকে বের হবে, সেদিন পুরুষতন্ত্র পালানোর রাস্তা খুঁজে পাবে না।
শোষিত নারীরা যেদিন একত্রিত হবে, এই একত্রিত শক্তির সামনে ভেতরে ফাঁপা পুরুষতন্ত্রের দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। নারীদের এবং পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষ শক্তিকে আহ্বান জানাবো আজকের সমস্যা সমাধান করার থেকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে যুদ্ধে এগিয়ে আসার।
দরকার স্থায়ী সমাধান।
শাব্বীর রহমান ।। উন্নয়নকর্মী