শিশুদের ওপর অপরাধ ও সহিংসতার প্রভাব

সামাজিক প্রেক্ষাপটে বর্তমানে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষ খুব অল্প বয়স থেকে অপরাধ সংঘটিত হতে দেখে। কখনো আবার শিশু বয়সেই অপরাধের শিকার হয় কিংবা অপরাধে লিপ্ত হয়। একজন শিশু পরিবারের ভেতরে থাকার দরুণ অনেক সময় অপরাধের সাক্ষী হয়ে ওঠে।
জানা গেছে, অল্প বয়সে সহিংসতার সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে, শিশুর মধ্যে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। যেমন—
১। আচরণগত, মানসিক এবং শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়া
২। শিক্ষাজীবনে জটিলতা বৃদ্ধি
৩। অ্যালকোহল বা মাদক অপব্যবহারে ভোগা
৪। অপরাধী হয়ে যাওয়া
৫। শিশু বয়সে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো অপরাধ করে ফেলা
অপরাধ, সহিংসতা, অবহেলা এবং ট্রমা শিশুর বিকাশের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে যেটা যেকোনো মাধ্যমে সেই অপরাধের মুখোমুখি হোক না কেন। ইউনিসেফ-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, সহিংসতা এবং অবহেলা শরীরবৃত্তীয়ভাবে একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে। যে শিশু সহিংসতার শিকার হয় তার জন্য বিষয়টি আরও বেদনাদায়ক।
অপরাধ কিংবা সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর জন্য স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ বৃদ্ধি, পড়ালেখায় অনীহা, কম শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ এবং পরবর্তী পারিবারিক জীবন ও অন্যান্য সদস্যদের প্রতি বিরূপ আচরণ করার উদাহরণ পাওয়া গেছে। ভয়ংকর হলেও সত্য যে, নির্যাতন বা অবহেলার অভিজ্ঞতা শিশুর জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা এবং সামাজিকভাবে দক্ষ হওয়া হ্রাস করতে পারে।
পরিবারই প্রাথমিকভাবে শিশুর মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার প্রধান নির্ধারক। আমরা সবাই জানি যে, কেউই নিখুঁত নয়, তাই কোনো পরিবারই নিখুঁত নয়। একটি পরিবার কোনোভাবে যদি অসামাজিক বা অপরাধমূলক আচরণ করে তার ফলাফল শিশুর আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে।
যখন কোনো শিশু অশান্ত পারিবারিক পরিস্থিতিতে থাকে, তখন মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য তারা সমবয়সীদের ওপর নির্ভর করে...
অন্যদিকে যখন শিশুর সাথে তাদের পিতামাতার ইতিবাচক, যত্নশীল সম্পর্ক চলমান থাকে এবং সেই পরিবারের পরিবেশে ধারাবাহিক শৃঙ্খলা থাকে, তখন তাদের ভবিষ্যতে অপরাধমূলক আচরণ বা মানসিক সমস্যা এড়ানোর (social control) সুযোগ তৈরি হয়।
পিতামাতার সাথে সন্তানদের যোগাযোগ ক্ষীণ হলে বা পারিবারিকবন্ধন দুর্বল হলে শিশুদের মধ্যে আক্রমণাত্মক অথবা অপরাধমূলক আচরণ করার প্রবণতা বাড়ে, প্রচলিত গবেষণায় এটা পাওয়া যায়। যখন কোনো শিশু অশান্ত পারিবারিক পরিস্থিতিতে থাকে, তখন মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য তারা সমবয়সীদের ওপর নির্ভর করে।
পরিবারের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে যদি শিশু আক্রমণাত্মক হয় ওঠে তবে এর ফলস্বরূপ অন্যান্য শিশুদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্রোধ সৃষ্টি করে। এভাবে শিশুরা আক্রমণাত্মক বা অসামাজিক হয়ে ওঠে। একটি শিশু যা পর্যবেক্ষণ করে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা সে সামাজিক কার্যকলাপে ব্যবহার করে।
স্কুলে বা অন্যথায় সহকর্মীদের সাথে কথোপকথনের সময় শিশুরা তাদের অভিভাবক বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অনুকরণ করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখতে পায় না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ কৌশলগুলো অসামাজিক আচরণ এবং আগ্রাসন তৈরিতে খুব প্রভাবশালী। মনোবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট বান্দুরা (Albert Bandura) আচরণ শেখার এই প্রক্রিয়াটিকে সামাজিক শিক্ষণ তত্ত্ব হিসেবে নামকরণ করেছেন।
আরও পড়ুন
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, উচ্চস্তরের সহিংসতা ও অপরাধপ্রবণ এলাকায় বসবাসরত শিশুদের মস্তিষ্কে সমস্যা হতে পারে, যা শিশুদের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে, সম্ভাব্য দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য নেতিবাচক ফলাফলের দিকে শিশুরা ধাবিত হয়।
লুক হাইড এবং তার সহকর্মীরা অনুমান করেছিলেন যে, অপরাধপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসের দরুণ শিশুদের মস্তিষ্কের স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেমের (আমিগডালা-Amygdala) কেন্দ্র প্রভাবিত হয়, যা আর্থ-সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, হুমকি প্রক্রিয়াকরণ এবং ভয় শেখার সাথে জড়িত।
অ্যামিগডালা একধরনের মুখের অভিব্যক্তি (বিরক্তি অথবা ভয়)। গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত বা অবহেলিত হয়েছে তারা নেতিবাচক, ভীত বা নিরপেক্ষ অভিব্যক্তিসহ মুখের দিকে তাকানোর সময় অ্যামিগডালায় বর্ধিত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
গবেষণা বলছে, যেসব শিশুরা টিভি বা অন্যান্য মাধ্যমে অপরাধ কিংবা সহিংসতা বেশি প্রত্যক্ষ করে, সেসব শিশুরা অন্যদের ব্যথা এবং কষ্টের প্রতি কম সংবেদনশীল হয়। উল্টোদিকে কিছু শিশু তাদের চারপাশের পরিবেশকে বেশি ভয় পেতে পারে। আবার কিছু শিশু অন্যদের প্রতি আক্রমণাত্মক বা ক্ষতিকারক উপায়ে আচরণ করার প্রবণতা বেশি থাকে।
যেসব শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালীন টেলিভিশনে বেশি সময় সহিংসতা দেখেছে তারা কিশোর বয়স থেকে আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
১৯৮০ এর শুরুতে মনোবিজ্ঞানী এল রাওয়েল হিউজম্যান, লিওনার্ড ইরন এবং অন্যান্যদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালীন টেলিভিশনে বেশি সময় সহিংসতা দেখেছে তারা কিশোর বয়স থেকে আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
যৌবনেও এই অংশগ্রহণকারীদের পর্যবেক্ষণ করা হয়। এল রাওয়েল হিউজম্যান, লিওনার্ড ইরন পর্যবেক্ষণে দেখতে পান, যেসব শিশুরা ৮ বছর বয়সে প্রচুর টিভি সহিংসতা দেখেছে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তারা অপরাধমূলক কাজের জন্য গ্রেপ্তার এবং বিচারের সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি ছিল।
এছাড়া শিশুদের মধ্যে অত্যধিক ভিডিও গেম দুর্বল সামাজিক দক্ষতা, পরিবার, স্কুলের কাজ এবং অন্যান্য শখ থেকে দূরে রাখে। তারা পড়াশোনায় কম মনযোগী হয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা তাদের কম থাকে, তাদের অতিরিক্ত ওজন হয় এবং আক্রমণাত্মক চিন্তাভাবনা এবং আচরণের দিকে তারা ধাবিত হয় বেশি।
শিশু যেকোনো মাধ্যমে অপরাধ প্রত্যক্ষ করুক না কেন, সেটা পরিবারের ভেতর অথবা বাহিরে, এই জাতীয় প্রকাশভঙ্গি তাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর সাথে উল্লেখযোগ্য শারীরিক, মানসিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা পরবর্তী জীবনে স্থায়ী হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
শৈশবে শিশুরা নির্যাতিত বা অবহেলার শিকার হলে তাদের অসামাজিক বা অপরাধমূলক আচরণ বিকাশের সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের বেশি থাকে। অবশ্যই এটি শিশুর দোষ নয়, কারণ তাদের পরিবেশের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
প্রাথমিকভাবে পরিবারই সন্তানের সুস্থ মানসিক গঠন নিশ্চিত করতে পারে। শিশুদের অপরাধের প্রভাব কমাতে ও অপরাধ থেকে দূরে রাখতে হলে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পিতামাতাকে প্যারেন্টিং-এর ক্ষেত্রে সন্তানদের সাথে প্রতিক্রিয়াশীল সম্পর্ক স্থাপন এবং তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে।
সন্তানদের সামনে পরিবারের যেকোনো ধরনের সহিংসতা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। একই সাথে মনোযোগ দিয়ে সন্তানদের কথা শোনা প্রয়োজন। পিতামাতার উচিত প্রকৃত আগ্রহ প্রদর্শন করে সন্তানের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিকে মূল্য দেওয়া। সন্তানদের বয়স অনুযায়ী ভালোবাসা দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা ছাড়াও শিশুদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া গেলে সন্তানদের ওপর পরিবার ও সমাজের ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রভাব কমে আসতে পারে।
খন্দকার ফারজানা রহমান ।। সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)