ফুটবলের আলোকবর্তিকারা নতুন পথ তৈরি করবে
বাংলাদেশ ফুটবল দীর্ঘদিন ধরেই অন্ধকারের মধ্যে পথ খুঁজে ফিরছিল। ক্রিকেটের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার ছায়ায় চাপা পড়ে থাকা ফুটবল যেন একটা অবহেলিত শিল্পকলার নাম ছিল। কিন্তু দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের মুখ হয়ে এসেছেন একদল তরুণ, সাহসী ও প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়, যাদের মধ্যে আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন হামজা চৌধুরী। হ্যাঁ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। লেস্টার সিটির হয়ে যিনি ইউরোপা লিগ পর্যন্ত খেলে এসেছেন (বর্তমানে শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে খেলছেন), সেই খেলোয়াড় যখন লাল-সবুজের পতাকা তুলে ধরেন, তখন সেটা শুধু একটি ম্যাচ খেলার গল্প নয়। এটা বাংলাদেশের ফুটবলের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার গল্প হয়ে যায়।
হামজা চৌধুরীর আগমন একটি প্রতীকী ঘটনা। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিভারা দেশের হয়ে খেলতে আগ্রহী। এই পথ ধরে এগিয়ে এসেছেন আরও কিছু নাম, ফাহমিদুল ইসলাম, সুমিত সোম, কিউবা মিচেল। তারা সবাই প্রবাসে গড়ে ওঠেছেন, কিন্তু হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করেন এবং দেশের ফুটবল সংস্কৃতির ধরনটাই বদলে দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
ফাহমিদুল ইসলাম ইতালীয় পেশাদার এক ফুটবলার, যিনি আমাদের ফুটবলে এমন এক ছন্দ এনেছেন, যা বহুদিন দেখা যায়নি। তার বল কন্ট্রোল, পাসিং ও খেলার গতিপথ বোঝার ক্ষমতা ইউরোপে খেলার ফসল। ঠিক তেমনিভাবে, যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা কিউবা মিচেল অপেক্ষা করছেন তার ম্যাজিক্যাল ফুটবল দেখানোর জন্য। তার ফিজিক্যাল প্রেজেন্স, ট্যাকল করার ধরণ ও গেম রিডিং প্রতিপক্ষের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সুমিত সোম, কানাডার পেশাদার ফুটবলার, যার পায়ে রয়েছে গতির ঝড়। তারা সবাই মিলে যেন একটি নতুন বাংলাদেশ ফুটবল দল গড়ে তুলছেন, যেটি কেবল প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করছে না, বরং আধিপত্য দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
তবে এই পরিবর্তনের বীজ বপন হয়েছিল আরও আগে। তারিক কাজী ও জামাল ভূঁইয়া সেই প্রক্রিয়ার পথিকৃৎ। জামাল ভূঁইয়া প্রথম যেদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপান, সেদিন অনেকে অবাক হয়েছিলেন, একজন বিদেশি ঘরানার ফুটবলার, যার বাংলাও স্পষ্ট নয়, কীভাবে জাতীয় দলের নেতা হবেন? কিন্তু সময় প্রমাণ করেছে, নেতৃত্ব মানে ভাষা নয়। নেতৃত্ব মানে দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মত্যাগ ও দলকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা।
তারিক কাজী ফিনল্যান্ডে বেড়ে ওঠা এক ডিফেন্ডার, যিনি বাংলাদেশ ফুটবলের ডিফেন্স লাইনে এনে দিয়েছেন কঠোরতা ও পেশাদারিত্বের নতুন মাত্রা। তার উপস্থিতি ডিফেন্সে একটি শৃঙ্খলা নিয়ে এসেছে, যা আগে খুব একটা দেখা যায়নি।
এইসব পরিবর্তন শুধুমাত্র মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়। এসব খেলোয়াড় আমাদের কিশোর তরুণদের জন্য একধরনের অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। আমাদের কিশোর তরুণরা হামজা, কিউবা, সুমিতদের দেখে বুঝতে পারছে, সঠিক প্রশিক্ষণ, সুযোগ ও আত্মবিশ্বাস থাকলে তারাও আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার হতে পারবে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিভাদের খুঁজে বের করে তাদের একটি প্ল্যাটফর্মে আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে প্রশিক্ষণ কাঠামো উন্নত করতে হবে, যেন এখানকার ছেলেরাও একই মানের খেলার সুযোগ পায়।
এখন হামজা চৌধুরী যখন বল নিয়ে মাঠে নামেন, সেটা কেবল একটি ফুটবল পাসের গল্প থাকে না; সেটি বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়ে ওঠে। আজকের এই আলোকবর্তিকারা আমাদের দেখাচ্ছেন, অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় পৌঁছানো সম্ভব। যদি ইচ্ছা থাকে, যদি পরিকল্পনা থাকে আর যদি সামনে থেকে কেউ পথ দেখাতে পারে। বাংলাদেশ ফুটবল আজ এক নতুন ভোরের দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা উপভোগ করতে চাই, উদযাপন করতে চাই ফুটবলে আমাদের এগিয়ে যাওয়া এবং সাফল্য।
রিয়াজুল হক ।। যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক