স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পাপটি ছিল ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট। তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক কুনাট্যের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশে—তার ঠিক ৭৯ দিন পর, পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর—জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই কুনাট্যের প্রথম অঙ্কের সমাপ্তি ঘটে।

এরপর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের যে স্খলন ঘটানো হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের মৌল ধারণাগুলো নির্বাসনে পাঠিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বে যে পাকিস্তানিকরণ করা হয়েছে—তার পুরোটাই সম্পন্ন হয়েছে পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক সময়ে।

সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ছেঁটে ফেলা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে অধ্যাদেশ জারি, সেই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দান, রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা, পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো ইত্যাদি অপকর্মগুলো যে সকল রাজনৈতিক নেতা ও দলের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে— পরিতাপের বিষয় হলো, আজও তারা ঘৃণিত তো নয়ই, বরং কোথাও কোথাও পুরস্কৃত।

তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সূত্র মতে, ১৯৭৭ সালে ৮৮.৫০% ভোটার ভোট দিয়েছেন। উপস্থিত ভোটারের মধ্যে ৯৮.৯% ভোটার ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন! ভোটার উপস্থিতির এমন বিপুল হার উপমহাদেশের আর কোনো নির্বাচনে হয়েছে কি না তা অজানা।

এখন ইতিহাস যেহেতু ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট পাত্র-পাত্রীদের সঞ্চারপথ থেকেও নির্মাণ করা যায়, তাই আজকের দিনে বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টিকে দেখলে চট করে তাদের অতীত পাপগুলো আমাদের মনে আসে না। বোধ করি সে কারণেই আজ যখন ‘বড় বড়’ মানুষদের লেখায় গণতন্ত্রহীনতা বিষয়ক করুণ ক্রন্দন শুনি, তখন আশ্চর্য হয়ে ভাবি, এই অশ্রু গত এক দশকের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে কেন? বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার ইতিহাস কি তবে মাত্র এক দশকের? নাকি এই ‘বড় বড়’ মানুষদের ভাবনা অতীতের অতখানি দেখতে পায় না!

এই যে ৩০ মে চলে গেল, কই, কেউ তো লিখলেন না, ১৯৭৭ সালের ৩০ মে কেমন ছিল বাংলাদেশ? খবরের কাগজ তো বিশেষ বুলেটিন বের করল না? ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সাড়ে সব্বনাশ হচ্ছে’ বলে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তারা আওয়াজ তোলেন, তেমন আওয়াজ কিন্তু জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট নিয়ে তারা তোলেন না।

বলছি না— এ কারণে তাদের আজকের আওয়াজটা ফাঁকা বুলির মতো শোনায়; কিন্তু সব ঘটনারই তো একটি শুরু থাকে। সেটা না বলে কেবল ঘটনা বললে আমরা ছোটরা তো বুঝতে পারি না— কোনটা ‘উনাদের’ পদ সেবা আর কোনটা চপেটাঘাত।

রাজনীতিরও একটি সংস্কৃতি থাকে আর সেই সংস্কৃতি তৈরি হয় পিপলস পালস থেকে। এখন এই পিপলস পালসের তো কোনো স্থায়ী নমুনা নেই। নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা কোটি কোটি টাকা খরচ করেন— তো এই টাকা খায় কে? কার পকেটে যায়? টাকা খেয়ে ভোট দেওয়ার স্বভাব তো আমাদের নতুন নয়; কিন্তু এই স্বভাবটা আমদানি হলো কোত্থেকে?

যে জনতাই সত্তরের নির্বাচনে ভয়-ডর-আশঙ্কা পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে তার ব্যালটের রায় দিয়েছিল, সেই জনতাই যে মাত্র সাত বছর পর হ্যাঁ-না ভোটের ঘুঁটি হলো—তার আয়োজনটা করলো কে? তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সূত্র মতে, ১৯৭৭ সালে ৮৮.৫০% ভোটার ভোট দিয়েছেন। উপস্থিত ভোটারের মধ্যে ৯৮.৯% ভোটার ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন! ভোটার উপস্থিতির এমন বিপুল হার উপমহাদেশের আর কোনো নির্বাচনে হয়েছে কি না তা অজানা।
মনে রাখতে হবে— জিয়াউর রহমান আয়োজন করেছিল গণভোটের, অর্থাৎ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকবে না। সামরিক কায়দায় ক্ষমতা হাতানোর এই প্রক্রিয়া অবশ্য জিয়াউর রহমানের আবিষ্কার নয়, এর প্রবক্তা আইয়ুব খান—জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানকে অনুসরণ করেছিল মাত্র।

তবে এমন একটি রাজনৈতিক পাপ প্রতিষ্ঠাকালে জিয়াউর রহমানকে আরও কিছু আয়োজন সম্পন্ন করতে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সরকারি আদেশে পনেরোই আগস্টের খুনিদের মধ্যে মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও মেজর নূরকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হয়।

ফারুক ও রশিদ ছাড়া সবাইকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনে চাকরি দেওয়া হয়। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বেসামরিক প্রশাসনের লাগাম হাতে নিতে জিয়াউর রহমানের খুব বেশি সময় লেগেছিল কি?

জিয়াউর রহমান আয়োজন করেছিল গণভোটের, অর্থাৎ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকবে না। সামরিক কায়দায় ক্ষমতা হাতানোর এই প্রক্রিয়া অবশ্য জিয়াউর রহমানের আবিষ্কার নয়, এর প্রবক্তা আইয়ুব খান—জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানকে অনুসরণ করেছিল মাত্র।

বাকি থাকল রাজনৈতিক ময়দান। এক আওয়ামী লীগ ছাড়া জিয়াউর রহমানের প্রতিপক্ষ কোথায়? সেই আওয়ামী লীগও নড়বড়ে। মওলানা ভাসানী আগে থেকেই জিয়ার সামরিক পকেটে ছিল। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে’র পর তার রাজনৈতিক সখ্য গড়ে ওঠে ভাসানী-ন্যাপের সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সাথে। যাদু মিয়ার বড় ভাই মোখলেসুর রহমান সিধু মিয়া ছিলেন আড়ালের খেলোয়াড়।

ষাটের দশকে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে তিনি জড়িত, এখানেই বা থাকবেন না কেন— ‘খড়কুটায় আগুন জ্বালাইয়া, পেত্নী বসছেন আলগোছ হইয়া’। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও সাবেক ছাত্রলীগের দল-বদলানো করুণা প্রার্থীরা তো ছিলই। এসব কিছু কি তৎকালীন জনমনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করেনি?

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) হয়ে বিএনপি যখন আত্মপ্রকাশ করল, ততদিনে তো জিয়া জেনে গেছে—ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তৎকালীন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজ বা সংস্কৃতিকর্মীরা কী আমার সঙ্গে এই মর্মে একমত হবেন না যে—বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক গোয়েন্দাতন্ত্র এতখানি প্রভাব রাখার সুযোগ আগে কখনো পায়নি।

বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল পর্যন্ত তৈরি হয়েছে জিয়ার তৎকালীন প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। দলের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হতো আর সেই চাঁদা ব্যবসায়ীরা ক্যান্টনমেন্টে হাজির হয়ে দিয়ে আসতেন। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা তো নয়, এখনও সেই ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বেঁচে আছেন। সেই সূত্রে ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক সুবিধা প্রদানের নজির এই সময়েই তৈরি হয়েছিল। আজ আমরা সংসদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি—রাজনীতিবিদের চেয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। কেন বেশি— সেই সূত্রটা অনুসন্ধান করি না।

এই রাজনৈতিক ঘটনাবলি কতগুলো কুৎসিত সত্যকে আমাদের সামনে এনে হাজির করেছে। জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততারও দরকার নেই—কেবল সামরিক খুঁটি থাকলে আর সংখ্যাগুরু ধর্মের ট্রাম্প কার্ড থাকলে রাজনৈতিক দল থেকে সংগঠন সব গড়ে উঠতে পারে।

এই সত্য কিন্তু এখনও বিরাজমান। কারণ জিয়া ও এরশাদের আমলে জলপাই রঙের ছাতার তলে বসে রাজনীতি করার মজা পেয়ে গিয়েছিল কিছু রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের নেতারা। সেই জের আজও টেনে চলছে বাংলাদেশ। কারণ রাজনীতির পরিধি বদল মানে, কেবল শাসনতন্ত্র আর ক্ষমতার বদল নয়, এই বদল জনগণের মানসিকতাতেও পরিবর্তন আনে। সুতরাং সৎ রাজনীতি তখন কেবল একটি রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করে না। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গোটা দেশের জনমানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। তারই প্রতিফলন ঘটে সংসদে, শাসনে, রাষ্ট্রক্ষমতায়।

মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার