বিমান দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও বাস্তবতা
মানুষ স্বপ্ন এবং ভাবনায় বাঁচতে চায়। পৃথিবীকে ভালোবেসে শান-মান, শক্তি, সাহসে দিব্যি হেসে খেলে ভোগ এবং ত্যাগের আভায় নিজেকে মেলে ধরতে চায়। এ যেন আজন্ম লালিত আকুতি এবং আকাঙ্ক্ষা। রবি ঠাকুরের কণ্ঠেও ভেসে এসেছে, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। এ প্রত্যাশা সবার। তাই বলে চাইলেই কি নশ্বর ভুবনে আজন্ম বেঁচে থাকা যাবে? মৃত্যুকে ঠেকানোর কি কোনো কৌশল আছে? ভাবলেই শিহরিত হতে হয়। মৃত্যু হলো মানবের নিশ্চিত পরিণতি। এ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পালিয়ে রক্ষা পাওয়া যাবে না। মৃত্যু অবধারিত। প্রাণ আসে প্রাণ যায় এ এক শৈল্পিক যাত্রা এবং মৃত্যু স্বাভাবিক ও বটে। সব মৃত্যুই দাগ কাটে না। বিয়োগান্তক ঘটনা এয়ার ইন্ডিয়ার ১২ জুন ২০২৫-এর বিমান দুর্ঘটনা সবার মনে ভাবনার জন্ম দিয়েছে। উড্ডয়ন আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা এবং যবনিকাপাত। বুকে কাঁপন ধরার মতো বিষয়। তারপরও কি আমরা সাবধান হই? কপটতা বক ধার্মিকতা, দালালি কারবারে সর্বদাই যেন মত্ত থাকি! কীসের আশায় এবং নেশায়? একবারের জন্য কি ভেবেছি?
দুর্ঘটনার এক পলক আগেও কি কারও মনে মৃত্যুর আগমনী বার্তা ছিল? এ যেন বিনে মেঘে বজ্রপাত! আর দশটা দিনের মতোই এয়ার ইন্ডিয়ার এআই- ১৭১ ফ্লাইটটি আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গেটউইকের দিকে যাত্রা করেছিল। আশা এবং স্বপ্ন নিয়ে ২৪২ জন আরোহী সমেত উড্ডয়ন। যেখানটায় বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের আধুনিক বিমানে আরামদায়ক ভ্রমণে নিশ্চয়তা ছিল। অথচ ওড়ার মিনিট কয়েকের মাঝেই মৃত্যুর মিছিল। এখানটায় সৃষ্টিকর্তার লীলা।
বিজ্ঞাপন
বিমানের ১১-এ আসনের যাত্রী বিশ্বাস রমেশ কুমার ব্যতীত সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ভয় জাগানিয়া শিরোনাম! এ ফ্লাইটে ভারতীয় ব্রিটিশ পর্তুগাল ও কানাডার নাগরিকরা ছিলেন এবং দৈবক্রমে মেডিকেলের আবাসিক স্থাপনায় বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে সেখানকার জনা-কয়েকের মৃত্যু ঘটে। এ যেন স্বপ্ন অনিশ্চিত এবং মৃত্যু অবধারিত এ বার্তারই নীরব প্রতিধ্বনি।
মৃত্যু নির্ধারিত সময়েই আসবে। খানিক আগে বা পরেও নয়। এ থেকে কেউ রেহাই পাবে না। যা ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনায় চাক্ষুষ প্রমাণ হিসেবে দেখা মিলল। রাজস্থানের প্রতীক যোশির সেলফিতে তিন সন্তান ও চিকিৎসক স্ত্রীকে নিয়ে যাত্রার শুরুতে ব্রিটেনের স্থায়ী বসবাসের উল্লাস এবং অল্পক্ষণের ব্যবধানে প্রাণ প্রদীপ নিভে যাওয়া এসব কীসের ইঙ্গিত বহন করে? খানিক আগে ও এমন পরিণতির কি আশঙ্কা করেছিল? ভূমি চৌহান নামের যাত্রী যানজটে ফ্লাইট ধরতে না পারায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। এ যেন মিরাকল! এসবই বলে দেয় মৃত্যুতে কারও হাত নেই। আমরা কি মৃত্যু নিয়ে একবারও ভেবেছি? চারিদিকের হতাশা অস্থিরতা জুট-ঝামেলা এবং অঢেল আকাঙ্ক্ষা কি আমাদের পরযাত্রার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
আহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনা কেন ঘটল? গাফিলতি বা যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানাবিধ বিশ্লেষণ হয়তো উন্মোচিত হবে। বোয়িং বিতর্কের ঢেউয়ের প্রভাবে লন্ডনের শেয়ার বাজারে দরপতন ঘটেছে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যাবে তবে কি মৃত্যু ঠেকানো যেত? আপাতত অনেক বিকল্প এবং মতামত প্রশমনের পথ খুঁজবে। বাস্তবতা কী বলে? কেননা মৃত্যু অবধারিত সত্য। চাইলেই কি এ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে? অথচ আমরা নিয়মিত আশায় বুক বাধছি। গাড়ি-বাড়ি, এয়ারকন্ডিশন, সোফা, খাট, ওয়াশিং মেশিন, যাই আশা করি না কেন প্রভুর সম্মতি ব্যতীত কোনো কিছুই অর্জন সম্ভব নয়।
মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ নশ্বর ধরায় স্থায়ীভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। হিটলার, মুসোলিনীসহ প্রতাপশালী কেউ মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায়নি। অথচ মানুষের দাম্ভিকতা অহমিকা ক্ষমতার আস্ফালন দেখে হাসি পায়। কীসের এত বড়াই? এবারের বিমান দুর্ঘটনায় টাটা গ্রুপের আন্তরিকতা ও মনুষ্যত্ববোধ গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলো এসবে বড়াই করার সুযোগ খুব কম। তাইতো জবাবদিহিতা পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দুর্ঘটনায় সব নিহত পরিবারকে এক কোটি রুপি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং ক্ষতিগ্রস্ত মেডিকেল ছাত্রাবাস পুনঃনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করার মাঝেই মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। দৌড়ঝাঁপ করে ক্ষতিপূরণের আবদার জানানোর প্রয়োজন পড়েনি। অথচ ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টসে ১১২ জনের প্রাণহানিতে ও তোবা গ্রুপের মালিক এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিহতের পরিবার কাঙ্ক্ষিত ক্ষতিপূরণ ও আশ্বাসের কার্যকারিতার দেখা পায়নি। কোথায় গলদ? এ কেমন রসিকতা!
স্বাভাবিক নিয়মেই দিন যায় রাত আসে। ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। সৃষ্টিকর্তার ইশারায় পৃথিবীতে প্রাণী আসছে এবং অমোঘ নিয়মে বিদায় ও হতে হয়। এ এক খেলা! প্রভুর আরাধনা সৃষ্টি ও স্রষ্টার দেওয়া দায়িত্ব এবং ভূমিকার মাঝেই মানবের পূর্ণতার দেখা মিলবে। কেন পৃথিবীতে মানুষ পাঠালো? এ প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই সৃষ্টির রহস্য। জগতে ভালোকে ভালো, কালো এবং সাদার মাঝে প্রভেদ সৎ পথে চলার মাঝেই স্রষ্টাকে খুঁজতে হবে। বকধার্মিকরা এসবে সাময়িক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, যারা সত্যকে আলিঙ্গন করেছে এসব মানুষ দুনিয়ার লোভ- লালসা পদ-পদবির চাকচিক্যের মোহে ক্ষ্যান্ত হতে পারে না।
সাম্প্রতিক আহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনা ই বলে দেয় মৃত্যু আমাদের চার পাশে আছে। কার কখন নোটিশ চলে আসে। এ থেকে চাইলেই কেউ রেহাই পাবে না। তাইতো কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানের কথায় এসেছে, পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয় মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়। এক্ষণে প্রয়োজন প্রস্তুতির। এমন জীবন গঠন করা লাগবে যাতে জগৎবাসী মৃত ব্যক্তির জন্য প্রতিনিয়ত আফসোস করে। হাছন রাজার গানের কথায়ও তা পাওয়া যায়। আগে যদি জানতো হাছন বাঁচব কতদিন বানাইতো দালান কোঠা করিয়া রঙ্গিন। এ নশ্বর জগতে চাইলেই থাকা যাবে না। যার যখন ফরমান আসবে ফিরে যেতেই হবে, টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। মৃত্যু বাস্তবতা মাথায় রেখেই স্বীয় সম্মান ও ভূমিকা পালন করার মাঝেই মানব জন্মের সার্থকতার তালাশ করা লাগবে।
ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস ।। অধ্যাপক , সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়