শৃঙ্খলা ফেরাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কী তত্ত্ব দেন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা কীভাবে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা যায়। শৃঙ্খলা বলতে এখানে আইনের শাসন, নাগরিকদের মধ্যে সহযোগিতা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকাকে বোঝায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন, যার মধ্যে উদারনীতিবাদ, রক্ষণশীলতা, মার্কসবাদ, আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ উল্লেখযোগ্য। এই লেখায় রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন তাত্ত্বিক পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
বিজ্ঞাপন
রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নটি রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে বারবার ফিরে আসা একটি মৌলিক বিতর্ক, যেখানে বলপ্রয়োগের সীমা, আইনের মর্যাদা, নাগরিকের সমর্থন এবং রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি—সবকিছুই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সামাজিক তত্ত্বের বিভিন্ন ধারার আলোকে দেখা যাক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক নির্দেশাবলী ও অন্তর্গত দ্বন্দ্বগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
টমাস হবস (Thomas Hobbes) শৃঙ্খলাকে “নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ন্যূনতম শর্ত” হিসেবে বর্ণনা করে ‘লেভিয়াথান(Leviathan)’-এ যুক্তি দেন, প্রাক-রাষ্ট্রীয় ‘ন্যাচারাল কন্ডিশন’‐এ সবার বিরুদ্ধে সবার যুদ্ধ চলতে থাকে; সেই অবস্থার ভয় থেকেই মানুষ সার্বভৌমের হাতে স্বেচ্ছায় সার্বিক ক্ষমতা ন্যস্ত করে।
বিজ্ঞাপন
জন লক (John Locke) এ ধারণা শিথিল করে বলেন, ব্যক্তির অমোঘ ‘ন্যাচারাল রাইটস’ (জীবন, স্বাধীনতা, সম্পদ) রক্ষাই রাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য; শাসকের অধিকার সীমিত এবং অন্যায় হলে জনগণের প্রত্যাহারের অধিকার রয়েছে।
রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো একক তত্ত্বই সম্পূর্ণ নয়। উদারনীতিবাদী আইনের শাসন, রক্ষণশীলদের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, শোষণমুক্ত সমাজ, আধুনিকতাবাদীদের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের বহুত্ববাদ—সবই প্রাসঙ্গিক।
রুশো (Jean-Jacques Rousseau) আবার ‘জেনারেল উইল’-এর মাধ্যমে সমষ্টিগত নৈতিক চুক্তিকে গুরুত্ব দেন। তিন দিক থেকেই স্পষ্ট, শৃঙ্খলা টিকে থাকে তখনই, যখন নাগরিকেরা ধারণা করেন যে রাষ্ট্র তাদের মৌলিক নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করছে—খাঁটি ভয়ের ওপর দাঁড়ানো সার্বভৌমিক শৃঙ্খলা দীর্ঘমেয়াদে ভঙ্গুর।
এডমন্ড বার্ক (Edmund Burke) ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে শৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। তার মতে, সমাজে ধীরে ধীরে বিকশিত প্রতিষ্ঠানগুলোই স্থিতিশীলতা আনে, আকস্মিক বিপ্লব নয়।
আধুনিক লিবারাল-ডেমোক্রেসি তত্ত্ব শৃঙ্খলার ভীত হিসেবে “সাংবিধানিকতা” ও “চেক-অ্যান্ড-ব্যালান্স” কাঠামোকে তুলে ধরে। জেমস ম্যাডিসন (James Madison) বা জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) দেখান, শক্তির বিকেন্দ্রীকরণই এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলে যেখানে আইন সব নাগরিক ও শাসক উভয়ের ওপরে সমানভাবে প্রযোজ্য। এখানে শৃঙ্খলা মানে শুধু অপরাধ প্রতিরোধ নয়; এটি হলো নাগরিক আস্থার সুতোয় প্রশাসনকে বাধা, যাতে বস্তুত “শাসনের সম্মতি” নিয়মতান্ত্রিক পথে তৈরি হয়।
এমিল ডুর্খেইম (David Émile Durkheim) দৃঢ়ভাবে বলেন, সামাজিক সংহতি (solidarity) বিঘ্নিত হলে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। যান্ত্রিক সংহতি-নির্ভর ঐতিহ্যবাদী সমাজে সম্মিলিত চাপে অনুশাসন বজায় থাকে; জৈবসংগত সংহতি-নির্ভর আধুনিক সমাজে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সম্মিলিত মূল্যবোধের রূপান্তরই মূল চালিকাশক্তি।
ট্যালকট পার্সনস (Talcott Parsons)-এর মতে, ‘সামাজিক ব্যবস্থা’ নির্দিষ্ট কাঠামোগত উপাদান (রাষ্ট্র, পরিবার, শিক্ষা, অর্থনীতি) দিয়ে নির্মিত—যার প্রত্যেকে ‘এ.জি.আই.এল.’ (অ্যাডাপ্টেশন, গোল-অ্যাটেইনমেন্ট, ইন্টিগ্রেশন, ল্যাটেন্সি) ফাংশন পূরণ করলে একটি স্থিতি অর্জিত হয়। শৃঙ্খলার মানদণ্ড তাই মূল্যবোধের অভিন্নতা ও কাঠামোসমূহের পারস্পরিক সামঞ্জস্য থেকে জন্ম নেয়।
ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) শৃঙ্খলার কেন্দ্রে রাখেন রাষ্ট্রের “বৈধ বলপ্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার”—অর্থাৎ পুলিশ, সেনা ও বিচার ব্যবস্থা যতক্ষণ বৈধ (legitimate) বলে স্বীকৃত, ততক্ষণ নাগরিকেরা বাধ্যতার প্রকাশ ঘটায়। ওয়েবারের তিন রকম বৈধতা—ঐতিহ্যিক, চারিম্যাটিক ও যুক্তিবাদী-আইনি—মধ্য থেকে আধুনিক রাষ্ট্র মূলত তৃতীয়টিকেই প্রাতিষ্ঠানিক করে; নিয়মতান্ত্রিক-আইনি কাঠামো ভেঙে পড়লে শৃঙ্খলা দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু হতে পারে, কারণ বল তখন স্বৈরতান্ত্রিক বলপ্রয়োগে রূপ নেয়।
কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) রাষ্ট্রযন্ত্রকে দেখেন শ্রেণি-শোষণের “সুপারস্ট্রাকচার” হিসেবে—যেখানে বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। শৃঙ্খলা এখানে শাসিতদের সচেতন বা অচেতন সমর্থন নয়, বরং দমন ও ভোগান্তির ফল।
আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci) অবশ্য ‘হেজেমনি’ ধারণা এনে বলেন, শাসক শ্রেণি কেবল বলপ্রয়োগে নয়, সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক নেতৃত্ব দিয়েও সর্বসম্মত সংহতি গড়ে তোলে; শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম, ধর্ম—সবই অংশীদার। এই যৌথ শক্তিতে শোষিত শ্রেণি অত্যাচারকে স্বাভাবিক ভেবে নেয়, ফলে বিদ্রোহ দমে থাকে—শৃঙ্খলা বজায় থাকে। তাই রাষ্ট্রে সত্যিকার ন্যায়ভিত্তিক শৃঙ্খলা আনতে হলে শ্রেণিগত বৈষম্য কাটিয়ে ক্ষমতার বিকল্প বিবেচনা আবশ্যক।
মিশেল ফুকো (Michel Foucault) দেখান, আধুনিক রাষ্ট্রে শাসন শুধু আদালত-কারাগারেই সীমাবদ্ধ নয়; “প্যানঅপটিক” নজরদারি, পরিসংখ্যান, বিদ্যালয় ও হাসপাতাল পর্যবেক্ষণের ল্যাবরেটরি হয়ে ওঠে, যেখানে মানুষের আচরণ সূক্ষ্মভাবে মাপা ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
শৃঙ্খলা তাই “যন্ত্রগতি-সদৃশ” অভ্যাস—ব্যক্তি নিজের ওপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করতে শেখে। এর ইতিবাচক দিক কার্যকারিতা, আবার নেতিবাচক দিক সামাজিক জীবনকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে বন্দি করা। নাগরিক-অধিকারের সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় নজরদারির ভারসাম্য ছাড়া এই শৃঙ্খলা সহজেই নিপীড়নে রূপ নেয়।
আরও পড়ুন
রবার্ট অ্যালান ডাহল (Robert Alan Dahl)‐এর ‘পলিআর্কি’ তত্ত্বে বলা হয়, যত বেশি দল, গোষ্ঠী ও চাপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নীতিনির্ধারণে অংশ নেবে, তত বেশি স্বার্থ‐সমন্বয় হবে, ফলে সামাজিক দ্বন্দ্ব হ্রাস পেয়ে শৃঙ্খলা সুদৃঢ় হবে।
অন্যদিকে মস্কা-প্যারেটো-মাইকেলস অভিজাততন্ত্রীয় ধারায় তর্ক করেন, প্রত্যেক সমাজেই “শাসক সংখ্যালঘু” থাকবেই; গণতন্ত্র কেবল সেই অভিজাতদের দায়িত্বশীলতা বাড়ায়। শৃঙ্খলা টেকসই হয়, যদি অভিজাতরা নিজেদের স্বার্থ জনস্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহি মেনে চলে।
ডগলাস সিসিল নর্থ (Douglass North) বা এলিনর অস্ট্রম (Elinor Ostrom) দেখান, সুঠাম “নিয়ম-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান” (rules-of-the-game) ও স্থানীয় অংশীদারিত্ব-ভিত্তিক শাসন কাঠামো শৃঙ্খলা স্থায়ী করে। পাবলিক-চয়েস অর্থনীতিবিদেরা আবার রাষ্ট্রীয় কর্মীদের ‘স্বার্থসন্ধানী’ (rent-seeking) প্রবণতা ব্যাখ্যা করে; শক্তিশালী স্বচ্ছতা-ব্যবস্থা, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন ও বিকেন্দ্রীকরণ এই স্বার্থবৈষম্য কমিয়ে শৃঙ্খলা বয়ে আনে।
আশিস নন্দী বা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণে উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে প্রশাসনিক কাঠামো ছিল ঔপনিবেশিক “কমান্ড” মডেলের উত্তরাধিকার; তাই জনগণের সঙ্গে দূরত্ব থেকেই দণ্ডপ্রয়োগে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চেয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রকৃত শৃঙ্খলা কায়েম করতে হলে স্থানীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপরে চেপে বসা “মেট্রোপলিটান” মানদণ্ড নয়—বরং অংশীজন সচেতনতা, ব্যবস্থাপনাগত উদ্ভাবন ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি জরুরি।
রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো একক তত্ত্বই সম্পূর্ণ নয়। উদারনীতিবাদী আইনের শাসন, রক্ষণশীলদের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, শোষণমুক্ত সমাজ, আধুনিকতাবাদীদের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের বহুত্ববাদ—সবই প্রাসঙ্গিক। একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রেক্ষাপটভিত্তিক পদ্ধতিই রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনতে পারে।
এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গেলে রাষ্ট্রকে নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং সমাজের সব স্তরের মানুষকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কেবল শক্তি প্রয়োগ নয়, বরং ন্যায় ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই টেকসই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গেলে রাষ্ট্রকে নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং সমাজের সব স্তরের মানুষকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো তথা দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় শৃঙ্খলা রক্ষার চ্যালেঞ্জ—রাজনৈতিক মেরুকরণ, আইনের শাসন দুর্বলতা, আর্থসামাজিক অসমতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহির ঘাটতি। উপরোক্ত তাত্ত্বিক আলোচনাগুলো থেকে কয়েকটি রূপরেখা টানা যায়:
(১) সামাজিক চুক্তির ন্যায় দৃশ্যমান সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাষ্ট্রকে বৈধতা দিতে হবে;
(২) আইনের শাসন দৃঢ় করতে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যম অপরিহার্য;
(৩) ব্যবস্থাগত স্বচ্ছতা ও বিকেন্দ্রীকরণ—পাবলিক-চয়েস মত অনুযায়ী—দুর্নীতি কমিয়ে মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মানতে উদ্বুদ্ধ করবে;
(৪) গ্রামশিয়ান ধারণা মাথায় রেখে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ালে হেজেমনিক সহমত শাসনের পক্ষে কাজ করবে;
(৫) ফুকোর সতর্কতা মেনে, সুরক্ষা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ভারসাম্য রক্ষা করে নজরদারি ও ডিজিটাল ডেটা-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে;
(৬) সর্বোপরি, উন্নয়নশীল-বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ন্যায়ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ছাড়া স্থায়ী শৃঙ্খলা সম্ভব নয়।
এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি দেখায়—শৃঙ্খলা কেবল “আইন মানো না হলে শাস্তি” নয়; বরং এটি রাষ্ট্র-সমাজ নৈতিক চুক্তির ফল, যেখানে সেবা, ন্যায়, জবাবদিহি ও নাগরিক সংহতি—সবকিছু একসঙ্গে সক্রিয় থাকে। এক-কেন্দ্রিক বল অথবা নিছক সাংস্কৃতিক হেজেমনিই যথেষ্ট নয়; কার্যকর রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা তাই বহুমুখী, প্রাতিষ্ঠানিক-স্থানীয়-মানসিক স্তরে সমন্বিত প্রয়াস দাবি করে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com