প্রি-টিন শিশুদের নিয়ে আমরা কি চিন্তিত?
শুরুর কথা
প্রাক-কিশোর বা ‘প্রি-টিন’ বয়স (প্রায় ৯ থেকে ১২ বছর) শিশুদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়। এই বয়সে শরীর, মন এবং চিন্তাধারায় দ্রুত পরিবর্তন আসে। একদিকে তারা আর ছোট নয়, আবার পুরোপুরি বড়ও নয়। ফলে এই পরিবর্তনের সময়ে নানা সমস্যা দেখা দেয়, যা অনেক সময় বাবা-মার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
বিজ্ঞাপন
প্রাক-কিশোর বয়সের সাধারণ সমস্যা
১. আত্মপরিচয় ও আত্মবিশ্বাসের সংকট:
বিজ্ঞাপন
এই বয়সে শিশুরা ‘আমি কে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। তারা নিজেকে নিয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে পড়ে—নিজের চেহারা, গায়ের রং, উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। অনেকেই বন্ধুদের সাথে উচ্চতার পার্থক্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে, আবার অনেকে নানাভাবে বন্ধুদের মধ্যে নিজের একটা বিশেষ জায়গা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
২. মেজাজ পরিবর্তন ও রাগ:
হরমোনজনিত কারণে আবেগের ওঠানামা স্বাভাবিক। হঠাৎ রেগে যাওয়া, মন খারাপ করা কিংবা অহেতুক বিরক্ত হওয়া সাধারণ আচরণ। এবং নানা রকমের আবেগের মধ্য দিয়ে যাওয়া, সে পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে দ্বিধায় পড়ে যাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা।
৩. বন্ধুদের প্রভাব ও চাপ:
বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, যেমন মিথ্যা বলা, লুকিয়ে কিছু করা কিংবা খারাপ ভাষা ব্যবহার করা, বন্ধুদের চাপে পড়ে নিজের নতুন আইডেন্টিটি তৈরি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়া, নতুনত্ব দেখাতে বা চমক দেখাতে বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সম্পর্কে বন্ধু মহলে আলোচনা, ঠাট্টা করা বা নানা রকমের মন্তব্য করা।
৪. প্রযুক্তি আসক্তি:
মোবাইল, গেমস, ইউটিউব বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা এখন একটি সাধারণ সমস্যা। এতে ঘুম, পড়াশোনা ও সামাজিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই বন্ধুদের সাথে কথা বলার বিষয় হয় কেবলমাত্র গেমসকেন্দ্রিক।
মোবাইল, গেমস, ইউটিউব বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা এখন একটি সাধারণ সমস্যা। এতে ঘুম, পড়াশোনা ও সামাজিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কে, কত নতুন গেমস ডাউনলোড করেছে বা খেলতে জানে বা কতগুলো লেভেল অতিক্রম করেছে। একই সাথে গেমসের পাশাপাশি ইউটিউবে বয়স অনুপযোগী ভিডিও দেখার ক্ষেত্রে আসক্তি তৈরি হয়। একের পর এক আসতেই থাকা ভিডিও শিশুদের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এক জায়গায় স্থির করে রাখে।
৫. পড়াশোনার চাপ ও অনীহা:
স্কুলের পড়ালেখা জটিল হয়ে যায়, কিন্তু মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়। কেউ কেউ চাপ সামলাতে না পেরে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। স্কুলে এ সময় হঠাৎ পড়াশোনার সিলেবাসে পরিবর্তন চলে আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষা পদ্ধতি শুরু হয়ে যায়।
পরীক্ষায় ভালো গ্রেড পাওয়ার প্রতিযোগিতার চাপ বড় আকারে আসে। নতুন নতুন শব্দ শেখা, নির্ভুল বাক্যের ওপর জোর বেড়ে যায়। অনেকে শব্দ সংখ্যা নিয়ে কাজ করা, চিন্তা করা, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চাপ চলে আসে। এগুলো শেখার একটা অংশ হলেও হঠাৎ বয়সের পরিবর্তনের সাথে সাথে কারিকুলামের এই চাপ সামাল দিতে গিয়ে শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই হিমশিম খায়।
কিছু সমাধানের উপায় নিয়ে ভাবতে পারি—
১. উন্মুক্ত যোগাযোগ গড়ে তোলা:
শিশু যেন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলতে ভয় না পায়। শিশুরা ভুল করলেও আগে তাদের কথা শুনে তারপর নিজেদের কথা বলা চাই।
২. নিয়ম ও সীমা নির্ধারণ করা:
প্রযুক্তি ব্যবহার, ঘুম, পড়াশোনা ও খেলার সময়ের একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করা চাই। কিন্তু সেটা চাপিয়ে না দিয়ে বোঝার ভাষায় আলোচনা করে ঠিক করা উচিত। এক্ষেত্রে শিশুর ঘুম ও বিশেষ করে ইচ্ছেমতো খেলা বা নিজের সাথে কাটানোর জন্য যথেষ্ট সময় রাখা জরুরি।
আরও পড়ুন
৩. ইতিবাচক প্রশংসা করা:
শিশুর ছোট সফলতাও প্রশংসা করা উচিত, সেলিব্রেট করা উচিত। যেমন খুব ভালো, দারুণ, চেষ্টা করতে থাকো, হচ্ছে, হবে, হাল ছেড়ো না এভাবে বোঝানো কার্যকরী হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। আর এভাবে বললে শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় ও ভালো কিছু করার আগ্রহ বাড়ে।
৪. রোল মডেল:
শিশুর সাথে যেমন আচরণ করা হবে, শিশু তাই অনুসরণ করবে। তাই অভিভাবক হিসেবে নিজেকে নম্র, ধৈর্যশীল ও সত্যবাদী হওয়া উচিত। অনেক অভিভাবক কথা বলার ক্ষেত্রে বিরক্তি দেখান, বেশ জোরে বকা দিয়ে কথা বলেন, কথায় কথায় ভুল ধরেন, গায়ে আঘাত করেন, স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের সাথে চিৎকার করে কথা বলেন এগুলো শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা।
কাজেই বাড়িতে শিশুর জন্য একজন রোল ও অনুসরণীয় মডেল হতে গেলে অভিভাবক হিসেবে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন আছে। তবে সবার আগে জরুরি হল শিশুকে যথেষ্ট সময় দেয়া ও সময় নিয়ে তার আবেগ, অনুভূতি ও দৈনন্দিন নানা অভিজ্ঞতার গল্পগুলো শোনা।
৫. মানসিক সহায়তা:
প্রয়োজনে কাউন্সিলরের সহায়তা নেওয়া চাই। অনেক সময় বাইরের একজন পেশাদার ব্যক্তি শিশুদের বেশি ভালোভাবে বোঝাতে পারেন। অনেকেই মনে করেন মানসিক সমস্যা না থাকলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে কেন যাব? কিন্তু এটা সঠিক নয়। শিশুর আবেগের নানা পরিবর্তনের জার্নিতে সব সময় যে বাবা-মা সাহায্য করতে পারবেন এমন নয়। এক্ষেত্রে ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার চেয়ে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত। আসলে একজন শিশুকে একা নয় বরং চারপাশের মানুষের সাহায্য নিয়েই বড় করে তোলা উচিত।
পিতামাতা হিসেবে নিচের উল্লেখ করা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারেন
১। সন্তানকে ভালোবাসুন নিঃশর্তভাবে, কিন্তু শাসনও করুন মমতার সাথে। এখানে বলে রাখা ভালো শাসন মানে প্রহার করা নয় বরং একটা সুশৃঙ্খল রুটিনের মধ্যে বড় হতে সাহায্য করা বোঝানো হচ্ছে।
২। শিশু যা বলছে তা গুরুত্ব দিয়ে শুনুন, প্রশ্ন করুন, কিন্তু তিরস্কার নয়। আমরা অভিভাবকেরা অনেক ক্ষেত্রেই কেবল ভুল ধরায় ব্যস্ত থাকি। ওদের শোনার ক্ষেত্রে নয় বরং ওদের ভুলের দিকেই আমাদের নজরদারি থাকে অনেক বেশি।
৩। পারিবারিক সময় বাড়ান—একসাথে খাওয়া, গল্প শোনা, হাঁটতে যাওয়া ইত্যাদি। শিশুকে একই সাথে ইনডোর এবং আউটডোর দুই ধরনের পরিবেশে নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে নিয়মিত প্রকৃতির মধ্যে খেলার সুযোগ তৈরি করার বিকল্প একেবারেই নেই।
শিশুকে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত। বাড়িতে এ বয়সের শিশুদের নিজেদের বাগান থাকতেই পারে। কোনোকিছুর যত্ন নেওয়ার অভ্যাস তাদের আবেগ এর নানা পরিবর্তনের জায়গায় কাজ করতে সাহায্য করবে। এছাড়াও একটা মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট শেখার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে।
শিশুর সাথে যেমন আচরণ করা হবে, শিশু তাই অনুসরণ করবে। তাই অভিভাবক হিসেবে নিজেকে নম্র, ধৈর্যশীল ও সত্যবাদী হওয়া উচিত।
৪। সন্তানকে শুধুই শিক্ষার্থী হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে শিখুন। এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আমরা সব সময় শিশুদের জন্য বলে থাকি, ও মানুষ হলেই খুশি কিন্তু এই মানুষ হওয়া বলতে কি বোঝাচ্ছি তা বোঝাতে পারিনা।
আসলে এ নিয়ে তেমন গভীরে আমাদের কোনো ভাবনা অনেক সময় থাকে না। কিন্তু ঠিক কীভাবে কেমন করে বড় করতে চাই এর মধ্যে কি সমাজের জন্য সেবা, মানুষের জন্য কাজ করা, দেশকে ভালোবাসা; এগুলো আসে না? কেবলমাত্র দেশ ত্যাগের ভাবনার মধ্যে শিশুকে বড় করা কি মানুষ হবার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে?
৫। ভুল করলে ‘তুই ব্যর্থ’, ‘তুই খারাপ ছেলে’—এমন কথার বদলে বলুন, ‘এই কাজটা ভুল হয়েছে, আবার চেষ্টা কর’। হ্যাঁ, শিশুকে বারবার ট্রায়াল অ্যান্ড এরর; এই কনসেপ্ট-এর সাথে খুব ভালো ভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জরুরি। শিশুকে বড় করতে হবে না শব্দটা স্বাভাবিক, এভাবে। বোঝাতে হবে ভুল করা মানেই জীবনের সব শেষ এমন নয়।
শেষ কথা:
প্রাক-কিশোর বয়স হলো জীবনের একটা অন্যরকম আবেগের পর্যায়। এই বয়সে যতটা ধৈর্য, ভালোবাসা ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়, ভবিষ্যতে ততটা সুন্দর ও গোছানো হবে। সন্তানদের সুশিক্ষায় বড় করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কিছু হতে পারে না, আর এই দায়িত্ব পালন শুরু হয় বোঝা, মেনে নেওয়া এবং পাশে দাঁড়ানো দিয়ে। আসুন এ বয়সে শিশুদের বোঝার চেষ্টা করি। কথা বলি। সময় দেই। নিজেকে একজন রোল মডেল হিসেবে শিশুর সামনে উপস্থাপন করি।
ফারহানা মান্নান : প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক