ভিকটিম-বান্ধব রাষ্ট্র গঠনে কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু অপরাধী দমন নয়, ভিকটিমকে রক্ষা, সেবা ও পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। তাই ধর্ষণ, এসিড-আক্রমণ, পারিবারিক সহিংসতা, যুদ্ধ-নিপীড়ন বা লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের শিকার যেই হোক-তাদের জন্য একীভূত, সম্মানজনক, মানবিক ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলাই রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।
একবিংশ শতাব্দীতে মানবিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ভিকটিম যেন রাষ্ট্রের বোঝা নয় বরং রাষ্ট্রের অঙ্গ হয়ে পুনর্জন্ম নিতে পারেন। যখন কোনো রাষ্ট্রে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন সেটি শুধু একজন নারীর ওপর নৃশংস আঘাত নয়- এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর সরাসরি প্রশ্নচিহ্ন।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে নারীর প্রতি সহিংসতা যখন সংঘটিত হয়-বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধ-তখন সেটি শুধু একজন নারীর ওপর শারীরিক-মানসিক আঘাত নয়; এটি গোটা রাষ্ট্র ও সমাজের মানবাধিকারের পরিস্থিতির ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তখন শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া নয় বরং ভিকটিমকে একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও সহানুভূতিশীল কাঠামোর মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়া।
দুঃখজনক হলো, অনেক ক্ষেত্রে বিচার বিলম্ব, ভিকটিম-ব্লেমিং ও মিডিয়া ট্রায়াল পরিস্থিতিকে আরও সংকটজনক করে তোলে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একজন ধর্ষণ, এসিড-আক্রমণ, পারিবারিক সহিংসতা অথবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার মানুষের রাষ্ট্রের কাছে মূল প্রত্যাশা হলো—নিরাপত্তা, সম্মান ও ন্যায়বিচার।
বিজ্ঞাপন
ভিকটিমের প্রতি কেমন আচরণ হবে, কীভাবে সে বিচার পাবে, সমাজ তাকে কীভাবে দেখবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করে একটি রাষ্ট্রের সভ্যতা ও দায়িত্ববোধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক সময় দেখা যায়, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অমানবিকতা কিংবা মিডিয়ার অসচেতনতা ভিকটিমকে আরও বিপদগ্রস্ত, নিঃস্ব এবং অসহায় করে তোলে।
এই বাস্তবতায়, আজ সময় এসেছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি আদর্শ রেসপন্স প্রদানের মডিউল গঠনের, যেখানে আইন, চিকিৎসা, মনস্তত্ত্ব, মিডিয়া এবং সমাজ সবাই ভিকটিমের পাশে দাঁড়াবে। আর এ বিষয়গুলো মোটেও লজ্জার নয় বরং মর্যাদার জায়গা থেকে। এই পরিস্থিতির উত্তরণে প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, অংশীজনভিত্তিক আদর্শ মডিউল, যা রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দ্রুত ও মানবিক প্রতিক্রিয়ার পথ তৈরি করতে পারে।
জাতিসংঘের UN Women বারবার বলেছে, ধর্ষণের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে Survivor-Centered Approach-কে। অর্থাৎ প্রতিটি পদক্ষেপে ভিকটিমের নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, মর্যাদা এবং মানসিক অবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান।
সুইডেন বা নরওয়ের মতো দেশে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেই ভিকটিমের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগকারী পুলিশ বা চিকিৎসককে বাধ্যতামূলকভাবে ‘জেন্ডার-সেন্সিটিভ কনসাল্টেশন’ ট্রেনিং থাকতে হয়। এমনকি ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করার সময়েও ভিকটিমকে পুনরায় ট্রমা না দেওয়ার নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন বা নরওয়ের মতো দেশে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেই ভিকটিমের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগকারী পুলিশ বা চিকিৎসককে বাধ্যতামূলকভাবে ‘জেন্ডার-সেন্সিটিভ কনসাল্টেশন’ ট্রেনিং থাকতে হয়। এমনকি ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করার সময়েও ভিকটিমকে পুনরায় ট্রমা না দেওয়ার নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী ‘Survivor-Centered Justice Model’ এখন যৌন সহিংসতার মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই কাঠামো পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। সেগুলো হলো—
(১) জরুরি নিরাপত্তা ও চিকিৎসা:
ভিকটিমের শারীরিক সুরক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহ করা। UNFPA-এর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক মেডিকেল কেয়ার নিশ্চিত না করলে অনেক প্রমাণই চিরতরে হারিয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতিটি হাসপাতালে ফরেনসিক মেডিকেল এক্সামিনেশন ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ভিকটিমের সম্মতি ছাড়া কোনো পরীক্ষা করা যাবে না;
(২) আইনি সহায়তা ও দ্রুত বিচার:
ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার পর ভিকটিমের জন্য বিচার প্রাপ্তির পথ দীর্ঘ ও জটিল হলে তা ভিকটিমকে যেমন পুনরায় ট্রমার মুখে ফেলে, তেমনি অপরাধীকেও উৎসাহিত করে। তাই ‘Survivor-Centered Justice Model’ এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে- আইনি সহায়তা ও দ্রুত বিচার। বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই যৌন সহিংসতা সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে।
২০১২ সালের দিল্লির ‘নির্ভয়া’ কাণ্ডের পর ভারত সরকার ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য Fast Track Special Courts (FTSCs) গঠন করে। ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে প্রায় ১০২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু ছিল, যার মধ্যে অনেকগুলো এক্সক্লুসিভলি ধর্ষণ ও পক্সো (POCSO) মামলার জন্য। এসব আদালত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুনানি ও রায় দেওয়ার জন্য নির্দেশনা মেনে চলে। এই উদ্যোগ আইনি প্রক্রিয়াকে ‘Survivor-Centered’ করার বড় উদাহরণ।
আরও পড়ুন
ফ্রান্সে ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমদের জন্য প্রটেক্টেড সাক্ষ্যগ্রহণ, নারী ম্যাজিস্ট্রেট এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে চার্জ গঠন ও শুনানির বিধান রাখা হয়েছে। আদালতের ভেতরে ও বাইরে ভিকটিমের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্যও বিশেষ অফিসার নিয়োজিত থাকে। ভিকটিম যেন ন্যূনতম মানসিক যন্ত্রণায় সাক্ষ্য দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে “single window testimony system”- যেখানে ধর্ষণ বা সহিংসতার শিকার ব্যক্তি শুধুমাত্র একবারই নির্ধারিত ও নিরাপদ পরিবেশে তার বক্তব্য প্রদান করেন, এবং সেই সাক্ষ্য পরবর্তী বিচারপ্রক্রিয়ায় পুনরাবৃত্তি ছাড়াই গ্রহণযোগ্য হয়।
(৩) মানসিক স্বাস্থ্য সেবা:
ভিকটিমের ট্রমা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন ট্রমা-ইনফর্মড কাউন্সিলিং। Amnesty International বলছে, “A rape survivor doesn’t need questions. She needs affirmation and empathy”. ট্রমা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে কাউন্সিলিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে। জুডিথ হারম্যানের ট্রমা অ্যান্ড রিকভারি (১৯৯২) তত্ত্বে বলা হয়েছে, ট্রমার প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক হস্তক্ষেপ ভিকটিমের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ।
(৪) মিডিয়া সংযম ও জনসচেতনতা:
ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ, দোষারোপমূলক প্রশ্ন (“সে রাতে বাইরে গেল কেন?”)—এসবকে জাতিসংঘের গাইডলাইনে “Secondary Victimization” বলা হয়েছে, যা একটি অপরাধের পর আরেক অপরাধ। ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে হবে।
(৫) সামাজিক পুনর্বাসন ও গ্রহণযোগ্যতা:
ভিকটিম যেন শিক্ষা, কর্মজীবন ও সামাজিক সম্মান পুনরুদ্ধার করতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসন তহবিল ও মানসিক সহায়তা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমি অংশীজনভিত্তিক UN Women ও UNFPA-এর Essential Services Package মডিউল অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও অনুসরণীয় একটি আদর্শ কাঠামো তুলে ধরতে পারি। যেটি বিশ্বের প্রায় ৮৫ টিরও বেশি দেশে প্রয়োগ হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও অন্যান্য অংশীজন কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে কিংবা ভূমিকা পালন করবে সে বিষয়ে আদর্শিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
রাষ্ট্র মূলত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ, পুনর্বাসন ব্যবস্থা করবে; পুলিশ জেন্ডার সংবেদনশীল তদন্ত, প্রমাণ সংগ্রহ, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করবে; হাসপাতাল মেডিকেল পরীক্ষা, ফরেনসিক রিপোর্ট, মনোরোগ চিকিৎসা বিষয়ে পেশাদারিত্ব বজায় রাখবে; আইনজীবী ভিকটিমের আইনি সহায়তা, আদালতে প্রতিনিধি ভূমিকা রাখবে; সংবাদমাধ্যম সংবেদনশীল প্রতিবেদন, পরিচয় গোপন, জনসচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করবে; এনজিও ও সিভিল সোসাইটি হটলাইন, কাউন্সিলিং, পুনর্বাসন করবে; সমাজ ভিকটিমকে পুনরায় গ্রহণ, সমর্থন, বিদ্বেষ প্রতিরোধ তৈরি করবে।
একজন ধর্ষণ Survivors-এর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—সে যেন নিজেকে অপরাধী মনে না করে। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি তাকে দোষারোপ না করে বরং তার পাশে দাঁড়ায়, তবে সে উঠে দাঁড়াতে পারবে। ধর্ষণ শুধু একজন নারীর ক্ষতি নয়, এটি রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক।
জাতিসংঘের নারী অধিকার কমিটি (CEDAW) সুপারিশ করে যে ধর্ষণ মামলার জন্য আলাদা ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট থাকা প্রয়োজন, যেখানে মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। ভারতের নির্ভয়া কোর্ট (Nirbhaya Court) বা দক্ষিণ আফ্রিকার সেক্সুয়াল অফেন্সেস কোর্ট এ ক্ষেত্রে মডেল হতে পারে। সেগুলো হলো—
(১) প্রমাণের নিয়ম শিথিলকরণ: অনেক দেশে ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমের ক্রস-এক্সামিনেশন পুনরায় ট্রমাটাইজিং হয়। ক্যাথরিন ম্যাকিনন যুক্তি দেন, লিঙ্গবৈষম্যমূলক আইনি প্রক্রিয়া ভিকটিমকে অপরাধী বানায়;
(২) ডিজিটাল এভিডেন্স: ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহে আধুনিক প্রযুক্তি (ডিএনএ, সিসি টিভি ফুটেজ) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে;
(৩) দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থান ও শিক্ষা: ভিকটিমদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও চাকরির কোটা রাখতে হবে, যেমন নরওয়েতে ভিকটিম কম্পেনসেশন স্কিম;
(৪) সামাজিক স্টিগমা মোকাবিলা: মার্থা নুসবমের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ অনুসারে, রাষ্ট্রকে নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে সামাজিক প্রচারণা চালাতে হবে;
(৫) আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: রাষ্ট্রকে ইস্তানবুল কনভেনশন, সিডও এবং UN Women-এর গাইডলাইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ফেমিনিস্ট তত্ত্ববিদ ন্যান্সি ফ্রেজার বলেছেন, ন্যায়বিচার কেবল স্থানীয় নয়, তা ট্রান্সন্যাশনাল। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন রোধে রাষ্ট্রকে একটি হলিস্টিক মডেল নিতে হবে, যেখানে ভিকটিমের প্রয়োজন থাকবে। আইন, চিকিৎসা ও সামাজিক পুনর্বাসন—তিনটি স্তরেই বিনিয়োগ জরুরি। নারীর নিরাপত্তা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পরীক্ষা; এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে রাষ্ট্রের দাবি করা সভ্যতা অর্থহীন।
এসব ক্ষেত্রে মূলত যে বিষয়টি দরকার সেটি হলো—‘দ্রুত, মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ’ সাড়া দেওয়ার কাঠামো- যেখানে কোনো Survivors দ্বিতীয়বার হেনস্তার শিকার হবেন না। যেখানে অপরাধী নয়, সমাজ বলবে- “তোমার লজ্জা নয়, লজ্জা তার- যে এই ঘৃণ্য কাজ করেছে।”
এই পুরো ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বিত ভূমিকা। পুলিশ যদি তদন্তে মানবিকতা না দেখায়, আদালত যদি সময়মতো বিচার না করে, সংবাদকর্মী যদি ভিকটিমকে অভিযুক্ত করে কিংবা সমাজ যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে- তাহলে কোনো মডিউলই কাজে আসবে না।
তাই প্রতিটি স্তরে প্রয়োজন মর্যাদার ভিত্তিতে সাড়া দেওয়ার সংস্কৃতি (Dignity-Based Response Culture)।
জুডিথ বাটলারের মতে, “নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুধু আইনি নয়, এটি রাজনৈতিক প্রতিরোধের বিষয়”। রাষ্ট্র যদি নিপীড়নকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্বোধন না করে, তবে সেটি ‘সংঘবদ্ধ রাষ্ট্র’ (Complicit State) অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝানো হয়, যে রাষ্ট্র নিজে অপরাধে সরাসরি জড়িত না থেকেও নীরবতা, উদাসীনতা বা নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে অপরাধকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে কিংবা অপরাধীর পক্ষ নেয়।
নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ একজন মানুষের মৌলিক ‘ক্ষমতায়ন’ (Capability) কে ধ্বংস করে। রাষ্ট্রের কাজ হওয়া উচিত, শুধু ন্যায়বিচার দেওয়া নয়, তার পূর্ণ সামাজিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। নারী নির্যাতনের পরে যদি রাষ্ট্র নীরব থাকে, তবে এটি মূলত ক্ষমতার সেই ন্যারেটিভকে চালু রাখে যেখানে পুরুষতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে। তাই রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ায় পাওয়ার ডিকনস্ট্রাকশন আবশ্যক, অর্থাৎ রাষ্ট্র, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ বা মিডিয়ার ভিতরে লুকিয়ে থাকা অসাম্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার বিশ্লেষণ করে তা ভেঙে ফেলা বা পুনর্বিন্যাস করা। যেমন-ধর্ষণের ঘটনায় যদি অপরাধী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয় এবং পুলিশ বা আদালত তাকে রক্ষা করে—এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। ভিকটিম গরিব, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হলে, তার কণ্ঠস্বরকে অবমূল্যায়ন করা-এটা ক্ষমতার শ্রেণিভিত্তিক দমন।
ধর্ষণের ঘটনায় যদি অপরাধী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয় এবং পুলিশ বা আদালত তাকে রক্ষা করে—এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। ভিকটিম গরিব, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হলে, তার কণ্ঠস্বরকে অবমূল্যায়ন করা-এটা ক্ষমতার শ্রেণিভিত্তিক দমন।
ধর্ষণের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শাস্তি হওয়া উচিত সেই ব্যবস্থার, যেখানে ভিকটিমকে লজ্জা পেতে হয়, যেখানে সে ন্যায়বিচার পাওয়ার আগেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র যদি চায় একজন নারী যেন ভয় ছাড়া সমাজে চলতে পারে, তবে তাকে ধর্ষণের পর এমন একটি সাড়া দিতে হবে, যা শুধু আইনগত নয়, নৈতিক এবং মানবিক-এই তিনটি ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো।
একটি আন্তর্জাতিকমানের আদর্শ মডিউল কেবল কাগজে নয়, বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলেই সম্ভব একটি সাহসী, ন্যায়ভিত্তিক ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ গঠন। তবে সার্বিকভাবে বলা যায় পরিস্থিতি সমাধান করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা উচিত। এমনকি সেই রোডম্যাপটি হবে যথাযথভাবে বাস্তবায়নযোগ্য।
এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। WHO Guidelines for medico-legal care for victims of sexual violence; UN Women – Essential Services Package for Women and Girls Subject to Violence (2015) গাইডলাইন অনুযায়ী, ধর্ষণের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা, পিপিই, প্রমাণ সংগ্রহ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। UNODC Handbook on Effective Police Responses to Violence Against Women (2010) গাইডলাইন অনুযায়ী নারী পুলিশ সদস্য দ্বারা ভিকটিম ইন্টারভিউ নেওয়ার বিষয়টি ট্রমা-সেন্সিটিভ ও ভিকটিম-সেন্টারড এপ্রোচ হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে।
UNESCO’s Gender-Sensitive Indicators for Media (2012) গাইডলাইন অনুযায়ী ধর্ষণ ঘটনার রিপোর্টিংয়ে ভিকটিমের পরিচয় গোপন রাখার নির্দেশনা রয়েছে এবং মিডিয়াকে ভিকটিম ব্লেইমিং এড়ানো ও দায়িত্বশীল প্রতিবেদন নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ জরুরি বলা হয়েছে।
UN Women – EVAW Programming Guidelines, India’s Nirbhaya Fund Model গাইডলাইন অনুযায়ী কিছু রিহ্যাব ব্যবস্থা থাকলেও আলাদা Survivor Fund চালুর প্রস্তাব আইন ও অধিকারকর্মীদের পক্ষ থেকে এসেছে। UNFPA Comprehensive Sexuality Education Guidelines-এ স্কুল পর্যায়ে যৌন শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
একটি সভ্য ও মানবিক রাষ্ট্র তখনই গড়ে ওঠে, যখন সে দুর্বলতম নাগরিকের কান্না শোনে এবং তাকে আগলে রাখে। ধর্ষণের পর একজন নারীর মানসিক, সামাজিক, শারীরিক ও আইনি পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত “Victim-Centered Integrated Response Model” শুধু ধারণা নয় বরং বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি সময়োপযোগী গাইডলাইন।
রাষ্ট্র যদি নারীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে তা শুধুই একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়-এটি নৈতিক ব্যর্থতা, একটি সামগ্রিক মানবিক বিপর্যয়। একটি রাষ্ট্র কতটা মানবিক, তা বোঝা যায় তার সবচেয়ে দুর্বল নাগরিককে কীভাবে সে সেবা দেয়, বিশেষ করে যারা সহিংসতার শিকার। আন্তর্জাতিক মডিউলের প্রতিটি স্তর বাস্তবায়ন করতে পারলে রাষ্ট্র শুধু ভিকটিমদের শুধু রক্ষা করতে পারবে না বরং ভবিষ্যতের সহিংসতা প্রতিরোধে নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারবে।
তথ্যসূত্র:
১। UN Women (2020) – Essential Services Package for Women and Girls Subject to Violence
https://www.unwomen.org/en/digital-library/publications
২। WHO Guidelines (2013) – Responding to Intimate Partner Violence and Sexual Violence Against Women
https://www.who.int/publications/i/item/9789241548595
৩। Amnesty International (2021) – Rape Survivors Still Denied Justice (Bangladesh and Global Report)
https://www.amnesty.org/en/latest/news
৪। UNESCO Media Reporting Guidelines – Gender-sensitive reporting of sexual violence
https://en.unesco.org/themes/gender-equality/guidelines
৫। National Rape Response Protocol – Canada, 2020 (Health Canada, Public Safety Collaboration)
৬। Justice for Women Amidst COVID-19, : UN Women, UNDP, UNODC, IDLO (2020), https://www.unwomen.org/en/digital-library/publications/2020/05/justice-for-women-amidst-covid-19
৭। Essential Services Package for Women and Girls Subject to Violence;, UN Women, UNFPA, WHO, UNDP, UNODC, https://www.unwomen.org/en/digital-library/publications/2015/12/essential-services-package-for-women-and-girls-subject-to-violence
৮। Butler, J. (1990) Gender Trouble: Feminism and the Subversion of Identity. Routledge, New York
৯। Sen, A. (1999). Development as Freedom. Oxford: Oxford University Press.
১০। Foucault, Michel, 1926-1984. (1977). Discipline and Punish : the birth of the prison. New York :Pantheon Books
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com