২০২১ সালের মে মাসের ৮ তারিখ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে আক্রান্ত রোগীর খবর নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। সম্প্রতি নতুন ভারতীয় ধরন আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা রোগী শনাক্তকরণের সাথে সাথে মৃত্যুহারও দিনদিন বেড়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, সরকার বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আংশিক কঠোর লকডাউনের চিন্তাভাবনা করছে।

সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটির উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতীয় মিউটেশনটির নাম দেওয়া হয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.৬১৭.২)। ইতোমধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশে বিস্তার ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সংস্থা গত ৫ জুনে বলেছে, তাদের দেশে আক্রান্ত ৬১% রোগীর দেহে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।

সাধারণত কোনো দেশের নাম দিয়ে ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করা হলে সেই দেশের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা বা ঘৃণা প্রকাশ শুরু হতে পারে। বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩১ মে থেকে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণের জন্য গ্রিক অক্ষর ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর এ প্রাপ্ত ইউকে ভ্যারিয়েন্টের পরিবর্তিত নাম আলফা ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.১.৭), ২০২০ সালের মে মাসে প্রাপ্ত দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের নাম বিটা ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩১৫) এবং ব্রাজিলে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্টের নাম গামা ভ্যারিয়েন্ট (পি.১) দেওয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস এবং এর জিনোমে ত্রিশ হাজার নিউক্লিক এসিড বেইজ একের পর এক বসে রয়েছে। এর যেকোনো একটি বেইজ পরিবর্তিত হলে নতুন মিউটেশনের ভাইরাস জন্ম হয়। মানবদেহে ভাইরাসটির বংশ বিস্তারের সময় ভাইরাসের আরএনএ থেকে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি হয়।

প্রোটিন হলো এমাইনো এসিডের সমষ্টি। একটির পর একটি এমাইনো এসিড ইটের মতো করে বসে প্রোটিন তৈরি হয়। ভাইরাসটির অত্যাবশ্যকীয় স্পাইক প্রোটিনটিও এভাবে তৈরি হয়, যা দিয়ে সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয়। যদি ভাইরাসটির জেনেটিক কোডে কোনো পরিবর্তন হয়, তবে স্পাইক প্রোটিনটির এমাইনো এসিডেরও পরিবর্তন ঘটে যায় অর্থাৎ প্রোটিনটির চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সংস্থা গত ৫ জুনে বলেছে, তাদের দেশে আক্রান্ত ৬১% রোগীর দেহে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।

এ পর্যন্ত হাজার বার করোনাভাইরাস তার জিনোমে মিউটেশন ঘটিয়েছে। তন্মধ্যে অন্তত ২০টি মিউটেশন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব করেছে অর্থাৎ প্রায় ১১ দিনে ভাইরাসটির নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

অধিকাংশ ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসটিকে প্রাথমিক পর্যায়ের (ওয়াইল্ড টাইপ) চেয়ে দুর্বল করে দিলেও কিছু কিছু ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসটির আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর দ্রুত সংক্রমণের সক্ষমতা, রোগীদের উচ্চ মৃত্যুহার এবং উপসর্গ বৃদ্ধির প্রকোপ পরিলক্ষিত হতে পারে। যেমনটি উপরোল্লিখিত নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ফলে এসব ভ্যারিয়েন্টগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন (ভিওসি) নামে আখ্যায়িত করেছে। অন্যদিকে মিউটেশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো ভ্যারিয়েন্ট পূর্বের চেয়ে দুর্বল হলে তা নিয়ে আশঙ্কা করার কিছু নেই।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশে। এর কারণ হলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে পূর্বে বিভিন্ন দেশে প্রাপ্ত ভ্যারিয়েন্টের মতোই আদি ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের প্রায় ১২টি জায়গায় মিউটেশন ঘটিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪টি গুরুত্বপূর্ণ জায়গার মিউটেশন আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। যেমন স্পাইক প্রোটিনটির ৪৫২ নম্বর স্থানের অ্যামাইনো এসিড লিউসিন এর স্থলে আরজিনিন (L452R) আসার ফলে অ্যান্টিবডি উৎপাদনের হার কমিয়ে দিয়েছে এবং ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা কমাতে সহায়তা করছে। 

অন্যদিকে ৬৮১ নম্বর স্থানে প্রোলিনের স্থলে আরজিনিন (P681R) সংযুক্ত হওয়ার ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ৬১৪ নম্বর স্থানে এসপার্টিক এসিডের স্থলে গ্লাইসিন (D614G) আসার ফলে খুব দ্রুত বিস্তার করছে। এছাড়া ৪৭৮ নম্বর স্থানে থ্রিওনিন এর স্থলে লাইসিন (T478K) যুক্ত হওয়ার ফলেও মানুষকে সংক্রমণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি একই সাথে বিস্তার, সংক্রমণের হার, মৃত্যুহার, উপসর্গ বা লক্ষণ বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করেছে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট একই সাথে ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধেও সংক্রমণ বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং অনেক সময় ল্যাবের টেস্টের ফলাফলেও ফলস নেগেটিভ দিচ্ছে।

এ পর্যন্ত হাজার বার করোনাভাইরাস তার জিনোমে মিউটেশন ঘটিয়েছে। তন্মধ্যে অন্তত ২০টি মিউটেশন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব করেছে অর্থাৎ প্রায় ১১ দিনে ভাইরাসটির নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট জার্নালের তথ্য বলছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ প্রাপ্ত রোগীদের দেহে খুব অল্প পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরে অ্যান্টিবডির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মোটামুটি সন্তোষজনক। অর্থাৎ দ্রুত দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। একেবারে ভ্যাকসিন কাজ করছে না, এই তথ্যটিও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। তাই অতি দ্রুত ভ্যাকসিন দিতে পারলে জনগণের দেহে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব। দ্রুত ভ্যাকসিন দিতে পারলে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার পরিবর্তন না হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার কমাতে সক্ষম।

এছাড়া নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসার ফলে ভাইরাসটিকে শনাক্তকরণ করার প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে আরটি পিসিআর পরীক্ষায় ব্যবহৃত কিটের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে, ফলে ভাইরাসটি ল্যাবের পরীক্ষায় শনাক্ত নাও হতে পারে। অন্যদিকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার হার যেমন বেশি হয়, তেমনি রোগীর হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ এর বিস্তার রোধ করতে না পারলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাপ বেশি পড়তে পারে। যেহেতু আইসিইউ এবং অক্সিজেনের স্বল্পতা আমাদের রয়েছে, সেক্ষেত্রে এই ভাইরাসটি রুদ্ররূপে দেখা দিতে পারে।

যুক্তরাজ্যে যারা আলফা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিল, তারা আবার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া শিশুরাও আক্রান্ত হওয়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সেসব দেশে পুনরায় লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে, স্কুল কলেজ বন্ধ রেখেছে, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। তাই, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নচেৎ ভারতের মতো আমাদের দেশেও ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। 

ড. মো. আব্দুল মুহিত ।। সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।