বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট সৃষ্টির মূল কারিগর হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতির আতুরঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এমনকি চব্বিশের ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃত্ব।

একসময় দেশের জাতীয় নির্বাচনের পর ডাকসু নির্বাচন সবার নজরদারিতে ছিল। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলে। ২০১৯ সালের পূর্বে প্রায় তিন দশক আগে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার শাসন আমলেও একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ডাকসু গঠন করা হয়। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আমান উল্লাহ আমান-খায়রুল কবির খোকনের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বিজয় লাভ করে। সেই নির্বাচনের পরপরই ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয়লাভের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদে (শাকসু) সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময়কাল ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসনামল। সেই নির্বাচনেও বিরোধীদল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কামরুল আহমেদ কাবেরী-আবদুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে শাকসু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। শাকসুর জয়লাভের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকার আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তথা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মতো কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করেনি। যা ছিল আওয়ামী সরকারের একটি ব্যর্থতার উপাখ্যান।

শাকসুর পর প্রায় দুই যুগের কিছু বেশি সময় পর এসিড টেস্ট হিসেবে আওয়ামী সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে ২০১৯ সালে। কিন্তু সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে তৎকালীন কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকারী নুরুল হক নুর বিপুল ভোটের মাধ্যমে সরকারি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পদপ্রার্থীকে পরাজিত করে। যার ফলাফল সরকার দলীয় সংগঠন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। এসিড টেস্টে পরাজিত হয়ে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।

চব্বিশের জুলাই আন্দোলন পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় পুনরায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের জোর দাবি উঠে। সেই দাবির প্রেক্ষাপটে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন। একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অপেক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা সারাবাংলার ছাত্র-সমাজ। শুধু ছাত্র-সমাজ বললে ভুল হবে, অপেক্ষায় আছে সারা জাতি। বিগত প্রায় দুই দশক নির্বাচনের যে আমেজ, একটি উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে তা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেটি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলছে। যার প্রথম পদক্ষেপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (ডাকসু)। আশা রাখছি, সবার প্রত্যাশা পূরণ করবে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ইতোমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর জাকসু ও রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের প্রায় দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়েছে। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আমেজ চলছে, তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যা অদ্ভুত রকমের বেমানান নিদর্শনে নিমজ্জিত সাস্ট। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়া একটি ক্যাম্পাসের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। একাডেমিক কার্যক্রমের বাইরে কো-কারিকুলাম কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন।

সুষ্ঠু রাজনীতির ধারাবাহিকতা নিরূপণে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো খুবই জরুরি। তাহলে শিক্ষিত জাতি গঠনে সৎ, যোগ্য নেতা তৈরি হবে।

সবার প্রত্যাশা, আসন্ন ডাকসু নির্বাচন হোক আগামীর নতুন বাংলাদেশ গঠনের উপলক্ষ্য। ডাকসুর মাধ্যমে একটি সুন্দর ভোরের প্রত্যাশায়।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট